এই মুহূর্তে ওরা রয়েছে এক ফিলিং স্টেশনে। তেল খাওয়াচ্ছে ইমপালাটাকে। স্টেশনটার নাম মার্টিনস সার্ভিস সেন্টার। এই মুহূর্তে সুনসান। অন্য কোনও গাড়ি নেই স্টেশনে। কমলা ওভারঅল পরা এক মেকানিক শুধু কী জানি করছে এক ধারে দাঁড়িয়ে। আরেক ধারে বাতিল এক গাড়ির বড়ি ফেলে রাখা হয়েছে।
সবগুলো পাম্পের গায়ে শোভা পাচ্ছে লাল নো স্মোকিং সাইন। কাঁচঘেরা অফিসটা নানান সাইনবোর্ড আর স্টিকারে জর্জরিত। টায়ারস। অয়েল। লুব্রিকেশন। ব্যাটারি। গ্যাস কথাটা বড় করে। আইস। কোল্ড বিয়ার।
হুশ করে পাশ কাটাল একটা গাড়ি। নভেম্বরের শুরু আজকে।
পেট্রলপাম্পের লাগোয়া, কনভেনিয়েন্স মার্ট থেকে বেরিয়ে এল আয়ান ইকরামুল্লাহ। হাতে জাঙ্ক ফুডের প্যাকেট। অন্য সময় হলে বিষবৎ পরিহার করত এসব ছাইপাঁশ। এখন উপায় নেই। এই দিয়েই পেট ভরাতে হবে। কাল রাতের পার্টির পর থেকে দানাপানি কিছু পড়েনি পাকস্থলিতে।
তেল নেয়া শেষ। নজলটা আবার পাম্পে রেখে দিচ্ছে আয়মান। তাকাল ভাইকে ফিরে আসতে দেখে।
প্যাকেট উঁচাল আয়ান। খাবি?
ন্নাহ! ভেংচে উঠল আয়মান ইকরামুল্লাহ। রোজা রেখেছি কি না! বেলা বাজে বারোটা, আর উনি জিজ্ঞেস করছেন… দে! ছোঁ মারল একটা প্যাকেটে। খিদেয় জান যায়! এ গাড়িতে বসেই খাওয়া সারল দুই ভাই। বোতলের পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করল।
এই পর্যন্ত চালিয়ে এসেছে আয়ান, এখন আয়মান বসেছে ড্রাইভিং সিটে।
থুতনিতে সস লেগে আছে তোর, বলল আয়ান। রিয়ার-ভিউ আয়না অ্যাডজাস্ট করে দেখল আয়মান। হাতের পোঁছায় চিবুক মুছল। ব্ল্যাক স্যাবাথ, না ডিপ পারপল? ইঞ্জিন চালু করার আগে অপশন দিল মেটাল-ভক্ত।
মুখ বিকৃত করল আয়ান। এই ভরদুপুরে! রবীন্দ্র সঙ্গীত দে।
উফ! এবার মুখ বাঁকাল আয়মান। কী যে মজা পাস এই প্যানপ্যানানি-মার্কা গানে! তা-ও আবার দুপুর বেলা।
গাড়ির প্লেলিস্ট চেক করে গান দিল আয়মান। জাগরণে যায় বিভাবরী- আঁখি হতে ঘুম নিল হরি। অসময়ের গান। তা-ও ভালো, এটা রিমিক্স। সোমলতার গাওয়া।
তিন
জেরিকো ৭ লেখা রোডসাইন পেরোল ধূসর ইমপালা।
রাস্তার এক পাশে পাহাড়। আরেক পাশে জঙ্গল।
মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছে আয়ান। ওদের মায়ের সঙ্গে।
…চিন্তা কোরো না, আম্মি। সময়মতোই চলে আসব আমরা। …(হাসি) ওকে, আম্মি। রাখি?
অক্সফোর্ড শার্টের পকেটে রেখে দিল সে ফোনটা।
কী বলল? ভাইকে জিজ্ঞেস করল আয়মান।
টার্কির স্পেশাল আইটেম থাকছে আজকে। লাঞ্চের আগে ফিরতে না পারলে জীবনেও আর ঢুকতে দেবে না বাসায়।
টার্কির মাংস! উলস! জিভে পানি আসার ভঙ্গি করল আয়মান। খোদ শয়তানও ঠেকাতে পারবে না আমাকে।
হেসে রাস্তার দিকে তাকাল আয়ান। একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে সামনে। ব্রিজের গোড়ায় গাড়ি আর পুলিসের জটলা।
স্লো কর, আদেশ করল।
কেন?
জবাব দিল না আয়ান। এক তাড়া আইডি কার্ড বের করল গ্লাভ-কম্পার্টমেন্ট খুলে। দ্রুত দেখতে লাগল একের পর এক। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা পেয়ে যেতেই হাসল দাঁত কেলিয়ে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানেই রাখ।
রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করল আয়মান। তাকাল ভাইয়ের দিকে। চোখে জিজ্ঞাসা।
একটা কার্ড ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল আয়ান। এটা তোর।
নিল আয়মান। এফবিআই-এর পরিচয়পত্র। কার্ডের ছবি আর সিগনেচারটা ওর। পাশে লেখা: স্পেশাল এজেন্ট।
ওদিকে আরেকটা আইডি পকেটে পুরেছে আয়ান।
কখন তৈরি করলি এগুলো? বোকা হয়ে গেছে আয়মান।
জবাব না দিয়ে দাঁত বের করল আয়ান। লেটস গো।
কাজটা কিন্তু বেআইনি।
আরে, দেশসেবার স্বার্থে সবই জায়েজ। মাসুদ রানা ভাব নিজেকে। তা হলেই দেখবি, খারাপ লাগছে না আর।
জেমস বণ্ডকেই প্রেফার করব আমি। ব্রিটিশ স্পাই-এর অনুকরণে বলে উঠল আয়মান; দ্য নেম ইজ বণ্ড, জেমস বণ্ড।
কপট হতাশায় মাথা নাড়ল আয়ান। এজন্যই কবি বলেছেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।
কোন্ কবি?
কবিগুরু…
উফ! আবার সেই বুঢ়ঢ়া! হেসে গাড়ি থেকে নামল আয়ান।
মাথায় হ্যাট। খাকি শার্ট আর প্যান্ট মানায়নি ডেপুটি ব্র্যাণ্ডের কালো চামড়ার সঙ্গে। কিন্তু উপায় কী! ইউনিফর্ম বলে কথা। চকোলেট-রঙা জ্যাকেট। বুকে ব্যাজ। বাহুতে আমেরিকান ফ্ল্যাগ। গলায় ঝুলছে টাই। টাইপিন, ব্যাজ আর জ্যাকেটের বোতামগুলো সোনালি। ঝুঁকল নিচে। দুই হাত কাঠের রেলিং-এ। হাঁক ছাড়ল: কিছু পাওয়া গেল?
দূরে, ওয়েটসুট পরা দু জন লোক পানি থেকে উঠে এসেছে নদীর নুড়ির চরায়। জবাব দিল একজন। নো! নাথিং!
সিডানটার দিকে ঘুরল পুলিস অফিসার। এগিয়ে গেল। ওটার নিখোঁজ আরোহীর জন্যই এত সব তৎপরতা। ব্রিজের মাঝামাঝি পড়ে আছে গাড়িটা।
এনি প্রোগ্রেস?
মাথা নেড়ে নিরাশ করল আরেক ডেপুটি। গাড়ির ভিতর থেকে জবাব দিল, ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই কোনও। ননা ফিঙ্গারপ্রিন্টস। নো ফুটপ্রিন্টস। পুরোপুরি স্পটলেস। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।
তুমি বলছিলে, এই চার্লি অ্যালান ছেলেটা প্রেম করত তোমার মেয়ের সঙ্গে।
হ্যাঁ, তা-ই।
সিণ্ডি কী বলে? জানিয়েছ ওকে?
ওদের তো বলে ঝগড়া হয়েছে।
কী নিয়ে?
জিজ্ঞেস করিনি।
করা উচিত ছিল। কবে হলো ঝগড়া, বলেছে কিছু?
কালকে, কাল রাতে।
ড্যাম। আর কাল রাত থেকেই নিখোঁজ চার্লি।
তুমি কি কিছু মিন করছ? সন্দিগ্ধ স্বর ডেপুটি ব্রায়ানের।