নিখাদ আতঙ্কে গলা ফাটাল ম্যাড়ি।
দুই
ধড়মড় করে জেগে উঠল আয়মান। উঠেই খেয়াল করল, ধূসর মেঘে মরে এসেছে দিনের আলো। কেমন ঘুম ধরানো স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। বিষণ্ণ প্রভাব ফেলে মনের উপরে। রওনা হওয়ার সময় এমনটা ছিল না। স্বর্ণালি রোদ ঝলমল করছিল তখন। [ পিটপিট করল ও চোখ দুটো। রগড়ে নিল ডান হাতের তর্জনি আর বুড়ো আঙুলের সাহায্যে। ঘুমের রেশ আঠার মতো লেগে রয়েছে যেন মগজের ভিতরটায়।
ও যে সিটটায় বসেছে, শটগান সিট বলে সেটাকে। পাশে গাড়ি চালাচ্ছে আয়ান। সাউণ্ড-সিসটেমে বাজছে: এসো নীপবনে… ছায়াবীথিতলে… এসো করো স্নান নবধারাজলে… এসো নীপবনে… ছায়াবীথিতলে…
বাঙালি ওরা। যমজ। আয়ানের দেড় মিনিটের ছোট আয়মান। উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে গ্রিন কার্ড নামের সোনার হরিণের দেখা পান ওদের বাবা আমান ইকরামুল্লাহ। সপরিবারে থিতু হন আমেরিকায়। আয়ান-আয়মান তখনও বিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখেনি। এরপর ক্যানসাসের উপর দিয়ে কত মেঘই এল, গেল। সেদিনের ছোট্ট সেই মানিকজোড় এখন তেইশ বছরের টগবগে দুই সুদর্শন তরুণ।
ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকাল আয়ান। নাইটমেয়ার?
চকিতে বড় ভাইকে দেখল আয়মান। কৌতূহলী মনে হচ্ছে আয়ানকে।
ডে-মেয়ার বলা উচিত, স্বভাবসুলভ রসিকতায় মাতল ছোটজন, মনটা ভার হয়ে আছে যদিও।
খেক।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ড্রাইভ করল আয়ান। তারপর জিজ্ঞেস করল: কী দেখলি?
উম? ওহ… দেখলাম, ফুল দিতে গেছি জানি কার কবরে। যেই না নামিয়ে রেখেছি তোড়াটা, অমনি একটা কঙ্কালের-হাত কবর ফুড়ে বেরিয়ে এসে চেপে ধরল আমার কবজি…
গলা খাঁকারি দিল আয়ান। সি-গ্রেড হরর ফিল্মের দৃশ্য।
ভয়টা কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস, কথার পিঠে বলে উঠল আয়মান।
তা হলে তো কথাই নেই, হালকা চালে মন্তব্য করল আয়ান। ছবি যেমনই হোক, ভয় পেলেই পুরো উসুল পয়সা।
গাড়ি রাখ। এমন ভাবে বলল আয়মান, যেন নেমে যাবে গাড়ি থেকে।
কেন? বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকাল বড়জন।
আমি চালাব।
জায়গা বদল করার পর জিজ্ঞেস করল আয়মান: অলরাইট… কোথায় আছি এখন?
ড্যাশবোর্ডের উপরে রাখা ম্যাপটা তুলে নিল আয়ান। ভাঁজ করা আছে ওটা। দেখে বলল: মাত্র বেরিয়েছি গ্র্যাণ্ড জংশন থেকে।
কলোরাডোর যে অংশটায় চোখ বোলাচ্ছে ও, লাল কালিতে বড় একটা ক্রস দেয়া ওখানটায়।
ইট স উইয়ার্ড, ম্যান! মন্তব্য করল একটু পরে।
কী?
এই যে, ব্ল্যাকওঅটর রিজ…
কী রকম?
জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই ওখানে। ম্যাপটা রেখে দিল আয়ান। মিডল অভ নোহোয়্যারে চলেছি আমরা।
একটা সাইনবোর্ডের পাশ কাটাল ওদের ইমপালা। বোর্ডে লেখা:
কলোরাডোর হারানো খাঁড়িতে স্বাগতম।
তিন
রেঞ্জার স্টেশন
লস্ট ক্রিক ট্রেইল
লস্ট ক্রিক ন্যাশনাল ফরেস্ট
সাইনটার পাশে। ধূসর ইমপালাটাকে পার্ক করাল আয়মান। আকাশের মুখ তখনও গোমড়া।
স্টেশনে ঢুকে একটা লোককেও দেখতে পেল না ওরা। বোধ হয় আছে ভিতরের রুমে। ক ন্যাশনাল ফরেস্টের ত্রিমাত্রিক একখানা মানচিত্রের দিকে নজর দিল আয়ান ইকরামুল্লাহ। আয়মান চোখ বোলাতে লাগল কামরার চারদিকে।
ক্যানিয়ন… রুক্ষ প্রান্তর… জঙ্গল আর সোনা-রুপার খনি নিয়ে অঞ্চলটা, ম্যাপ দেখতে দেখতে মন্তব্য করল আয়ান।
ভাই… ডাকল আয়মান। তাকাল ওর দিকে বড় ভাই।
সাইজটা দেখ ভালুক মিয়ার! ভয় লাগে না?
ফ্রেমবন্দি এক দেয়ালের-ফোটোগ্রাফের দিকে নির্দেশ করছে আয়মান। মাটিতে শোয়া অতিকায় এক ভালুকের পিছে দাঁড়িয়ে এক লোক, কাঁধের উপরেশটগান।
জুনিয়রের পাশে এসে দাঁড়াল আয়ান। পড়ল ছবির নিচের ক্যাপশনটা।
এক ডজনেরও বেশি গ্রিজলি আছে এই এলাকায়… আওড়াল বিড়বিড় করে। সিনসিনারি দেখতে দেখতে ঘোরাফেরা করা যাবে না… বুঝলাম।
নিঃশব্দে ওদের পিছনে উদয় হলো এক ফরেস্ট রেঞ্জার। হাতে কফির কাপ। ধোঁয়া উঠছে কাপ থেকে।
লোকটা যখন কথা বলে উঠল, একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল আয়ান আর আয়মান।
তোমরা নিশ্চয়ই ব্ল্যাকওঅটর রিজের আশপাশে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছ না- বাই এনি চান্স?
ওহ, নো, স্যর, তাড়াতাড়ি বলল আয়ান। ইউসি বোল্ডার থেকে আসছি আমরা। এনভায়রনমেন্টাল স্টাডির উপরে মেজর করছি। একটা রিসার্চের জন্য… হাসল ও বাকিটা শেষ না করে। ভাইয়ের দিকে এক ঝলক তাকাল আয়মান। লস্ট ক্রিকের পাথর নিয়ে গবেষণা করব আমরা। রিজের দিকে যাবই না, যোগ করল নিজে।
সন্দেহ গেল না রেঞ্জারের চেহারা থেকে। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়… ডেইজি মেয়েটার বন্ধু তোমরা, ঠিক না? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটা। সাত ঘাটের পানি খাওয়া মাল।
মাইণ্ড রিডার নাকি? ভাবল আয়ান। মুখে বলল: জি জি… ঠিকই ধরেছেন…
আসলে, ডেইজি গার্ডনারকে চেনেই না ওরা। মেয়েটা আসলে ওদের এক ফ্রেণ্ডের পরিচিত। দুই ভাই-ই যে রহস্যের পাগল, জানে ওই বন্ধুটি। সেজন্য তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করেছে আয়ান আর আয়মানকে। তার ধারণা, বিপদে পড়েছে ডেইজি।
ওয়েল, বলল বয়স্ক লোকটি। ওকে যেটা বলেছি, ঠিক সেটাই বলছি তোমাদের। ক্যাম্পিং-এর অনুমতি নেয়ার সময় ফর্মে লিখেছিল ম্যাডি: চব্বিশ তারিখের আগে ব্ল্যাকওঅটর থেকে ফিরছে না ও। আজকে দশ চলছে। তার মানে, এই মুহূর্তে নিখোঁজ হিসাবে ধরা যায় না ওকে, তা-ই না?
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল আয়ান।