জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা একটা জায়গা বেছে নিয়ে তাঁবু ফেলা হয়েছে এক জোড়া। ক্যাম্পফায়ারের উষ্ণতার ঘেরের মধ্যে বসে সাপার শেষ করেছে মানুষগুলো, এরপর গিয়ে ঢুকেছে তাঁবুতে। অদূরে জ্বলছে এখনও আগুনটা, তবে ক্রমে তেজ কমে আসছে ওটার।
সন্ধ্যা থেকে সেই যে রাতের রাগিণী ধরেছে ঝিঁঝিরা, থামাথামির নাম নেই। একঘেয়ে আওয়াজ হলেও বিরক্তি আসে না তাতে এক রত্তি। কারণ, শব্দটা প্রাকৃতিক।
সব মিলিয়ে তিনজন ওরা- ফ্লয়েড, টিম আর ম্যাডি। তরুণ বয়সী তিন বন্ধু। একটায় রয়েছে টিম আর ফ্লয়েড, অন্য তাঁবুটায় ম্যাডি।
হ্যাণ্ডহেল্ড ভিডিয়ো-গেমস খেলছে দুই বন্ধু। জয়স্টিকের উপরেই গেমের ডিসপ্লে। ব্লু-টুথ সিসটেম রয়েছে যন্ত্রে, সেজন্য আলাদা-আলাদা সেট নিয়েও পার্টিসিপেট করতে পারছে একই গেমে।
ওরে, শালা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ফ্লয়েড। একের পর এক ফাউলই করছিস শুধু…
তোর মতন আনাড়ি তো বলবেই এ কথা, মুখ ঝামটে জবাব দিল টিম।
ম্যাডি ওদিকে ভিডিয়ো-সেলফি রেকর্ড করছে ফোনে।
হাই, ডেইজি। হাই, রনি। ভাই-বোনের উদ্দেশে হাত নেড়ে হাই করল ম্যাডি। বোকাটে একটা হাসি ধরে রেখেছে। মুখে। কী অবস্থা? এক হপ্তা পুরল আজ আমাদের ক্যাম্পিং এর। ব্ল্যাকওঅটর রিজের কাছাকাছি রাত কাটাচ্ছি এখনও…
কালো একটা ছায়া খেলে গেল ছেলেটার পিছনে, তাঁবুর গায়ে। এত দ্রুত সরে গেল ছায়াটা যে, ঠাহরই করা মুশকিল, ঠিক কী ছিল ওটা। তবে অস্বাভাবিক কিছু যে, কোনও সন্দেহ। থাকতে পারে না এতে। মুহূর্তটা বন্দি হয়ে গেল ম্যাডির সেলফোনে। কিন্তু ও টের পায়নি কিছু। বা পেলেও রাতের জঙ্গলের হাজারও ছায়ার নড়চড় ছাড়া ভিন্ন কিছু মনে হয়নি ওর কাছে।
ভালোই আছি আমরা, রেকর্ডিং চালিয়ে যাচ্ছে ম্যাডি। নিরাপদে আছি। কাজেই, একদম চিন্তা করবে না, কেমন? কালকে আবার কথা হবে। টেক কেয়ার। বাই। এবার হাত নেড়ে বাই করল। তারপর স্টপ টিপে বন্ধ করে দিল রেকর্ডিং। দু -চারবার এখানে-ওখানে টেপাটেপি করে সেণ্ড করে দিল মেসেজটা। বা অন্য তাঁবুতে তখন গেম-সেটটা এক পাশে ছুঁড়ে ফেলেছে। ফ্রয়েড
ওই, ওই! হই-হই করে উঠল টিম। যাস কই? জিতছি দেখে পালাচ্ছিস, না?
ততক্ষণে টেন্টের জিপার খুলতে শুরু করেছে ফ্লয়েড।
ন-না, ঘাড় ফিরিয়ে জবাব দিল।
তা হলে?
ডাক দিয়াছে প্রকৃতি মোরে… সুর করে বলল ফ্লয়েড।
রইব না আমি কিছুক্ষণ তোদের মাঝারে… হায়, রে, ডাক দিয়াছে প্রকৃতি মোরে…
দূর, শালা, হারু পাটি! আপত্তির ভঙ্গিতে মুখ খিচাল টিম। চলবে না এসব এক্সকিউজ।
ফিচেল হেসে মুখ ভেঙচাল ফ্লয়েড।
বাইরে বেরিয়ে চেইন টেনে দিল আবার।
মিহিন হাওয়া পরশ বোলাচ্ছে গায়ে। নিজেকে হালকা করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল একটু দূরের পুরানো এক সাইপ্রেসের বিপরীতে। ভূতের মতো চেহারার সুউচ্চ এই জাতের গাছের আধিক্য এদিকটায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের আবহ এনে দিয়েছে জঙ্গলে।
পট-পট আওয়াজে আগুনে পুড়ছে কাঠ। রাতের স্তব্ধ পরিবেশে কানে ধরা দিচ্ছে স্পষ্ট।
প্যান্টের চেইন খুলে জিনিসটা বের করতেই মট করে শব্দ হলো একটা। মাটিতে পড়ে থাকা গাছের ডাল মাড়িয়েছে। যেন কোনও কিছুতে।
শব্দের উৎসের দিকে ঝট করে ঘাড় ঘুরে গেল ফ্লয়েডের। আঁধারে গাছের পাতার ভৌতিক ঝিরিঝিরি ছাড়া কিছুই পড়ল।
নজরে। হঠাৎই খেয়াল হলো, কখন যেন থেমে গেছে। ঝিঁঝিদের কলরব।
তা হতেই পারে। মাথা ঝাঁকিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের দিকে মনোযোগ দিল ফ্লয়েড।
পিশাবের মাঝখানেই চাপতে হলো আবার। কী রকম যেন একটা আওয়াজ ঢুকেছে কানে। শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় গড়গড়া করছে কেউ যেন!
আওয়াজটার পীড়াদায়ক কাঠিন্য চমকে দিল ওকে। কোত্থেকে আসছে ওটা? উপর
সময়ই পেল না আর ভাববার। বিকট এক গর্জন তালা লাগিয়ে দিল দুই কানে।
মিস্টি গ্রিফিন-এর টিয়ারস অভ দ্য সাইলেন্সড পড়তে ধরেছিল ম্যাডি, গর্জনটা- সেই সঙ্গে কানে এসে ধাক্কা মারল ফ্রয়েডের আতঙ্কিত চিৎকার। মাঝপথেই গলা টিপে থামিয়ে দেয়া হলো যেন আওয়াজটা।
টিমেরও আত্ম চমকে গেছে পর-পর দুটো দু রকম আওয়াজ শুনে। বন্ধুর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বিছানা থেকে উঁচু হলো ও গড়ান দিয়ে।
ফ্লয়েড! টিম! নিজের তাঁবু থেকে হাঁক ছুঁড়ল ম্যাডি।
হচ্ছেটা কী, বল তো! ঠিক আছিস তো তোরা?
আছি-ই! অনিশ্চিত গলা শোনা গেল টিমের।
ভয়ে ভয়ে মাথা বের করল ও তাঁবুর চেইন খুলে। পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। সতর্ক চোখে জরিপ করে নিল ইতিউতি তাকিয়ে। কই, স্বাভাবিকই তো মনে হচ্ছে সব কিছু!
তারপর একটা গরগরানির আওয়াজ কানে যেতে মুখ তুলে চাইল উপরে।
হেঁচকা টান দিয়ে তুলে নেয়া হলো ওকে তাঁবু থেকে। হতভাগ্য টিমের তীব্র আর্তনাদ দ্বিতীয় বারের মতো ফালা ফালা করে দিল রাতের শরীর।
জ্বলতে থাকা লণ্ঠনটা তড়িঘড়ি করে নিভিয়ে দিল ম্যাডি। ঢোক গিলছে ঘন ঘন। সৎ করে-করে তাঁবুর বাইরে সরে যাচ্ছে বিচিত্র ছায়াকাঠামো। আগুনের আভায় ওটাকে অনুসরণ করার চেষ্টায় এদিক থেকে ওদিক সরছে ওর ভয়ার্ত চোখ দুটো।
আচমকাই থেমে গেল গুরুগম্ভীর গরগরানি। নেমে এল স্নায়ু-বিধ্বংসী নীরবতা। কেবল একটা সেকেণ্ডের জন্য।
ধারাল নখরযুক্ত একটা থাবা ফড়াত করে চিরে দিল তাঁবুর দেয়াল।