রাতভর বর্ষণের পর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। আকাশটা মনে হচ্ছে কোবাল্ট ব্লু রঙের। এত নীল!
চনমনে ভাব বাতাসে। টুইই-টুইই করে নাম না জানা একটা পাখি ডাকছে ফুলের দঙ্গলে। দেখা যাচ্ছে না।
বুক ভরে শ্বাস নিল মনিকা। বুকের উপরে দুই হাত বেঁধে রাজনন্দিনীর মতো তাকাল এদিক-সেদিক। ওর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হওয়ার মতো কাউকে দেখতে পেল না আশপাশে।
ঘাড় ফিরিয়ে হাসি দিল জনের উদ্দেশে।
গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বউয়ের প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল জন। হাসল চোখে চোখ পড়তে। এগিয়ে গেল সামনে।
আমাদের বাড়ি? ভীষণ রোমাঞ্চ অনুভব করছে মনিকা। চোখেমুখে মুগ্ধতা।
হ্যাঁ, ডার্লিং।
তৃপ্তিতে ভরে উঠল মেয়েটার বুক। নিজের বাড়ি! মাথা নাড়ল ওর গর্বিত স্বামী।
ওহ, জন! শিশুর মতো উচ্ছ্বাস দেখাল মনিকা। এত সুন্দর বাড়ি জিন্দেগিতে দেখিনি।
হাসল জন। নিজেদের একটা বাড়ির চাইতে সুন্দর কিছু আছে পৃথিবীতে? আগে যেখানটায় থাকত, বিচ্ছিরি এক অ্যাপার্টমেন্ট ছিল সেটা।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে হয় টেরাসে। রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দা। শুধু সিঁড়ির মুখটা খোলা।
হাত ধরাধরি করে উঠে এল ওরা। সদর দরজার সামনে এসে থামল।
ব্রাস-নকার বসানো দরজার গায়ে। উপরের দিকে কাঁচের প্যানেল। ফ্রস্টেড।
পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল জন। বিশেষ একটা চাবি খুঁজে নিয়ে ধরিয়ে দিল মনিকার হাতে।
লাজুক হাসল মেয়েটা। হাসিটা ফিরিয়ে দিল জুন। তালা খুলল মনিকা। ঠেলা দিল পাল্লা। হাততালি দিল জন। তারপর দু জনেই চমকে উঠল একটু। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, ভ্যানের কর্মচারীরাও করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে ওদেরকে।
আন্তরিক ধন্যবাদ দিল ওদের স্বামী-স্ত্রী। সাবধানে কাজ করতে বলে চৌকাঠ ডিঙাল জন বউকে নিয়ে।
নিরেট শূন্য ঘর।
ঘরের মাঝখানে এসে ব্যালে নৃত্যের ভঙ্গিমায় একপাক ঘুরল মনিকা। দেখতে লাগল চারপাশটা। তাকাল সিলিং-এর দিকে। নির্মেঘ আকাশের মতো নিষ্কলুষ ছাত।
কী সুন্দর নতুন-নতুন সৌরভ ছড়াচ্ছে সব কিছু থেকে! সদ্য পেইন্ট করা সফেদ দেয়াল, উপরতলায় যাওয়ার সিঁড়ি, মোমপালিশ করা তেলতেলে মেঝে- সব একেবারে বকঝকে
সিঁড়ির গোড়ায় এসে উপরে তাকাল মনিকা। স্পর্শ করল কাঠের রেলিং। মসৃণ। বার্নিশের মিষ্টি সুরভি এল নাকে।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করল ও। ধীরে ধীরে। কাঠের উপরে জুতোর হিলের শব্দ উঠতে লাগল। ঠকাস। ঠকাস।
ওর পিছু নিল জন।
প্রশস্ত ল্যাণ্ডিং-এ গিয়ে শেষ হয়েছে ধাপ। পিকচার উইণ্ডো পাশে। খিড়কি গলে রোদ আসছে।
বাইরে রোজ-র্যাম্বলারের ঝাড়। বেড়ে উঠেছে বাতায়ন ছুঁয়ে। তিরতির কাঁপছে পাতা।
জানালায় মুখ ঠেকাল মনিকা। নাকটা চেপ্টে গেল কাঁচে। রাস্তার ওধারের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। সাদা হুডি পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ ছোট একটা কার্টন তুলে নিল ভ্যানটা থেকে। এগিয়ে আসছে বাড়িটার দিকে।
অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো, মনিকার। কী জানি ঠেকে আছে গলায়। আশ্চর্য! জল আসছে কেন চোখে?
ঘুরে দাঁড়াতেই ভুবন ভোলানো হাসি হাসল জন। দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল ওকে মনিকা। চুমু খেল।
বলো তো, এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচাইতে সুখী মানুষ কে? গলাটা কাঁপছে ওর আবেগে। নিজেই উত্তর দিল, আমি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ডিয়ার! এটা আমার বেস্ট বার্থডে গিফট।
তিন
পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে পিক-আপ দুটোকে বিদায় করতে করতে বেলা পড়ে এল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও-দুটোর চলে যাওয়া দেখল জন।
অল্পবয়সী এক মা প্যারাসুলেটর ঠেলে ঢুকে গেল এক বাড়ির গেট দিয়ে।
বিদায়ী রোদ্দুরটায় যেন জাদু আছে। কেমন মায়াবি লাগছে সব কিছু। কেমন আপন। মনেই হচ্ছে না, নতুন জায়গা এটা।
বাসায় ঢোকার জন্য ঘুরতেই দেখতে পেল জন মহিলাকে।
পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। বেঁটে। বোঝা যায়, সুন্দরী ছিল এক সময়। নরম কাপড়ের ট্রাউজার পরনে। গায়ে পুরুষের শার্ট। খড়রঙা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে এক পাশে আটকানো।
কাছে এল। সহৃদয় হাসি দিয়ে বলল, গুড ইভনিং। আজকেই এলে বুঝি?
মহিলার মুখে সিগারেটের গন্ধ পেল জন। জি। সে-ও। হাসছে আন্তরিক।
ভালোই হলো। নতুন পড়শি পেলাম।
কাছেই থাকেন আপনি?
আধ ব্লক দূরে। একটা দিক দেখাল হাত দিয়ে। ভদ্রমহিলার হাতে খবরের কাগজ। অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল জনের দিকে। তামারা ব্রাইস।
নাম শুনে অনুমান করল জন- আইরিশ মহিলা। তবে কথায় টান নেই কোনও। চেহারাসুরতও টিপিক্যাল মার্কিনদের মতো। হাতটা ধরতেই ঝাঁকিয়ে দিল। ছোট্টমোট্ট হলেও জোর আছে গায়ে।
জন ডিউক, বলল যুবক।
আমেরিকান? জনের ইংরেজিতে জড়তা নেই কোনও; কিন্তু ওর কালো চুল, কালো চোখ দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে মিস ব্রাইসকে।
ইয়াহ।
বাপ বাঙালি জনের। অনেক বছর আগে এসেছিলেন এখানে, চাকরিসূত্রে। পরে সেটল করেছেন। জনের আমেরিকান মায়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন তাকে। সেই সুত্রে পান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতু।
এখানেই জন্ম জনের। অতএব, সে-ও এই দেশের নাগরিক।
সেকথা বলল ও মহিলাকে।
কোথাকার লোক তোমার বাবা? ইনডিয়া নিশ্চয়ই!
নো, ম্যাম, বাংলাদেশ। একটু হাসল জন। মনে মনে। বলল, এরপর আপনি জিজ্ঞেস করবেন, বাংলাদেশ জায়গাটা। কোথায়। সচরাচর যেটা হয়।
কিন্তু ওকে বিস্মিত করে দিয়ে বলে উঠল ভদ্রমহিলা, ওয়াও! রিয়েলি? আমার এই শার্টটা কিন্তু ইমপোর্টেড ফ্রম বাংলাদেশ!