অদ্ভুত একটা কণ্ঠে সে বলল, ‘ইনভেরাওয়ি, খুনিকে রেহাই দেবে না। রক্তের বদলে রক্ত। খুনিকে ক্ষমা করবে না…’
বিছানায় উঠে বসলেন ইনভেরাওয়ি। চোখের সামনে আনলেন হাতজোড়া। যেন দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। আবার যখন তাকালেন ছায়ামূর্তিটা ফিকে হতে হতে অদৃশ্য হয়েছে। কেবল তার বলা কথাগুলো বাজছে জমিদারের কানে।
পরের দিনও ইনভেরাওয়ি শপথ ভাঙলেন না। প্রেতাত্মার কথা শোনার বদলে খাবার নিয়ে গেলেন মেচনিভেনের জন্য। নরকের কীটটার সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। কেবল খাবারটা মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে একবারও পিছু না ফিরে চলে এলেন।
এই রাতেও, যেমনটা তিনি আশা করেছিলেন, তাঁর পালক ভাইয়ের প্রেতাত্মা আবার হাজির হলো। হতাশা নিয়ে আবারও ওই একই সাবধানবাণী শুনলেন, ‘ইনভেরাওয়ি, ইনভেরাওয়ি! খুনিকে ক্ষমা করবে না। রক্তের বদলে রক্ত চাই।’
সকাল হতেই ইনভেরাওয়ি বুঝে গেলেন, তাঁর কর্তব্য কী। গুহায় ছুটে গেলেন। মেচনিভেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আর তোমাকে রক্ষা করতে পারব না আমি। এবার নিজের পথ দেখো।’
‘কিন্তু, স্যর,’ মিনতি করল মেচনিভেন, ‘ওরা আমাকে খুঁজে বের করে মারবে। আপনি কথা দিয়েছিলেন আমাকে বাঁচাবেন।’
‘আমি তোমাকে বাঁচাব, কথা দিয়েছিলাম,’ কাটখোট্টা গলায় বললেন, ‘কথা রেখেছিও। আর তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। খাবার নিয়ে আর এখানে আসব না আমি। হয় চলে যাও, নয় ক্ষুধায় মরো।’ বেশ স্বস্তি পেলেন সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে। ভাইয়ের প্রেতাত্মা রাতে হানা দেবে না, আশা করলেন। রাতে ঘুমাতে গেলেন নিশ্চিন্ত হয়ে।
কিন্তু হতাশ হতে হলো তাঁকে। আগের দু’দিনের সময়েই হাজির ভূতটা। খুব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ইনভেরাওয়ি, ইনভেরাওয়ি! একবার তোমাকে সতর্ক করেছি। দ্বিতীয়বার সতর্ক করেছি। এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। টিকোনডেরোগাতে আবার দেখা হবে আমাদের।’ তারপরই অদৃশ্য হলো প্রেতাত্মা।
‘না, এখনও দেরি হয়নি,’ নিজেকে বললেন ইনভেরাওয়ি, ‘আমি শোধ নেব। ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা আমার কথা দেয়ার চেয়ে বেশি কিছু। রক্তের বদলে রক্ত ঝরবে।’ ভোরের দিকে গুহার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মেচনিভেনকে খুন করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আবিষ্কার করলেন লোকটা চলে গেছে।
ভূতটা আর হাজির হয়নি। কিন্তু তিন রাতের ওই অভিজ্ঞতা ইনভেরাওয়িকে হতাশাগ্রস্ত এক মানুষে পরিণত করল। অনেক সময়ই ক্রুচান পাহাড়ে হাঁটতে দেখা যায় তাঁকে। অনিচ্ছাকৃতভাবে ভাইয়ের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তাঁকে এভাবে মন্থর পায়ে উদাস দৃষ্টিতে হাঁটতে দেখে লোকেরা করুণার দৃষ্টিতে তাকায়।
‘দুঃখী জমিদার,’ বলে তারা, ‘কীভাবে এমন বদলে গেল! ভাইয়ের জন্য মনটা খারাপ থাকে সবসময় তাঁর!’ কেবল তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরাই জানেন সত্যি ঘটনাটা।
কিছুদিন বাদে, ১৭৫৬ সালে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় আমেরিকায়। ৪২ রেজিমেন্টের এক মেজর ছিলেন ক্যাম্পবেল অভ ইনভেরাওয়ি। অন্য সেনাদের সঙ্গে জাহাজে চাপেন তিনি। জুনে নিউ ইয়র্ক পৌছেন তাঁরা। সেখান থেকে যান আলবেনি। ১৭৫৭ সালের বসন্ত পর্যন্ত সেখানেই মোটামুটি অলস সময় কাটে।
এক সন্ধ্যার ঘটনা। এখনও পুরানো সেই ঘটনাটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে তাঁর ওপর। লেফটেনেণ্ট-কর্নেল গ্রান্টকে জিজ্ঞেস করলেন টিকোনডেরোগা নামের কোন জায়গার কথা শুনেছেন কিনা।
‘না,’ জবাব দিলেন কর্নেল, ‘নামটা বেশ অদ্ভুত। এর কথা জানতে চাইছ কেন? কোন গল্প আছে নাকি জায়গাটিকে নিয়ে তোমার?’
একটু দ্বিধা করলেন ইনভেরাওয়ি। ওখানে তখন অন্য অফিসাররাও উপস্থিত ছিলেন। হয়তো টিকোনডেরোগার কথা কেউ জানতেও পারেন! হয়তো এক প্রেতের সতর্ক সঙ্কেতের বিষয়টা হেসেই উড়িয়ে দেবেন। একই সঙ্গে আবার ভাবলেন কাহিনীটা তাঁর মনটা হালকা করবে। অতএব গোটা ঘটনাটাই খুলে বললেন।
কেউ কেউ বিশ্বাস করলেন তাঁর কথা। কেউ আবার এটাকে একটা গালগপ্পো বলেই ধরে নিলেন। তবে মেজরের মনের অবস্থা বুঝে কেউ তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলেন না। অফিসারদের একজনও টিকোনডেরোগার নাম শোনেননি।
পরের বছর মেজর-জেনারেল অ্যাবারক্রমবির নেতৃত্বে লেক জর্জের ফরাসী দুর্গ সেন্ট লুইসে একটা অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ এল। দলটি রওয়ানা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে একজন অফিসার কর্নেল গ্রান্টকে এসে বললেন, ‘স্যর, এই মাত্র যে তথ্যটা পেয়েছি তা তোমাকে জানানো কর্তব্য মনে করছি। টিকোনডেরোগা নামটা কি মনে করতে পারছ?’
‘একটু ভাবতে দাও। টিকোনডেরোগা? কেমন পরিচিত ঠেকছে! ও, হ্যাঁ! এখানেই মেজর ক্যাম্পবেলের প্রেত ভাই ওর সঙ্গে দেখা করার কথা বলেছে। ক্যাপ্টেন হঠাৎ ওই জায়গাটির কথা বলছ কেন?’
‘কারণ, স্যর, আমরা এখন সেন্ট লুইস’ নামের যে জায়গাটিতে যাচ্ছি তা আমেরিকার আদিবাসীদের কাছে টিকোনডেরোগা নামে পরিচিত।’
‘ক্যাম্পবেলকে বিষয়টা না জানানোই ভাল,’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন কর্নেল, ‘যা-ই ঘটুক না কেন, তাঁর কাছে এ নিয়ে মুখ খুলবে না।’
জুলাইয়ের শুরুর দিকে রওয়ানা হয় দলটি। গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে টিকোনডেরোগার দিকে চলতে থাকে। পথে একটা যুদ্ধে ফরাসী দলকে মোটামুটি নাস্তানাবুদ করে। জুলাইয়ের দশ তারিখ শুরু হয় আসল লড়াই।