সিংগাপুরিয় মনে-মনে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল লোকটার ওপর। ভিতরে তাকিয়ে আরও দুজনকে দেখতে পেল। তিনজনে মিলে তাস খেলছিল। লোকগুলো তাকে বলল ওপরতলায় উঠে বিছানায় শুয়ে পড়তে। তারা রাতভর খেলা চালিয়ে যাবে। লোকগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সে। এখানে এসে অবাক হয়ে দেখল কিছু আসবাবপত্র এমনকি আয়নাসহ একটা ড্রেসিং টেবিলও আছে কামরাটায়। তবে ওটা নিয়ে বেশি একটা চিন্তা করল না। কাপড় ছেড়ে চারটা বিছানার একটায় শুয়ে পড়ল।
রাতের কোনো এক সময় সিংগাপুরিয় লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। এসময়ই দেখল সাদা পোশাক পরা এক মহিলা ড্রেসিংটেবিলে বসে ধীরে-সুস্থে তার লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে লোকটাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল মহিলাটি। চিরুনিটা নামিয়ে রেখে তার দিকে ফিরে একটা হাসি দিল। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে পাল্টা হাসল সিংগাপুরিয় লোকটাও।
তারপরই নিজের মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল মহিলাটি। আতংকে চিৎকার করতে চাইল লোকটা। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। মহিলাটি নড়ছে না। তবে টেবিলের ওপর রাখা মাথাটা তার দিকে চেয়ে হাসছে।
থর থর করে কাঁপছে লোকটা। তবে শেষ পর্যন্ত নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পেল। পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল সে।
দেখল নীচের তিনজন এখনও শান্তভাবে তাস পিটিয়ে যাচ্ছে। বাঁচাও, বাঁচাও, হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল সিংগাপুরিয়, ওপরে একটা মহিলা দেখে এলাম, মাথা খুলে ফেলল চোখের সামনে।
তিন তালুড়ে খেলা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর একজন-একজন করে নিজেদের মাথা খুলে টেবিলে রাখতে লাগল।
রহস্যময় হাত
এবারের কাহিনিটা শুনিয়েছেন সিংগাপুরের ২৪ বছর বয়স্কা এক সরকারী চাকরিজীবী। আমরা এটা তাঁর মুখ থেকেই শুনব।
বাবা-মার সঙ্গে একটা দু-তলা বাড়িতে থাকি আমি। একদিন বেশ রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে পড়ছি। কারণ রাতে দেরি করে ঘুমালেও কিছু আসে যায় না আমার। সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার তাগিদ নেই। পা মচকে যাওয়ার কারণে কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। যে গল্পের বইগুলো কিনেছি অবসর কাটানোর জন্য তার সবগুলোই পড়ে শেষ। ওগুলোর একটারই আবার পাতা উল্টাচ্ছি।
আমার বিছানাটা জানালার দিকে মুখ করা। নীচের তলার গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকটা বারোটা বাজার সংকেত দেওয়ার ঠিক সঙ্গেসঙ্গে একটা শব্দ কানে এসে বাজল। জানালার কাছে বাইরের দেয়ালে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। তারপরই জানালার ধারে একটা মহিলার হাত দেখা গেল। হাতটাতে কয়েকটা আংটি পরা। হাতটা জানালা গলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। মহিলার জামার আস্তিনের একটা অংশও নজরে পড়ছে। কালোর ওপর গাঢ় লাল নকশা কাপড়টায়।
ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। জানালা গলে বেশ কিছুটা ঢুকে পড়েছে ইতিমধ্যে হাতটা। জামার হাতার অনেকটুকু দেখা যাচ্ছে এখন। গোড়ালির মারাত্মক ব্যথা থাকা সত্ত্বেও লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বারান্দায় এসেই বাবার সঙ্গে ঢাক্কা খেলাম। আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
হড়বড় করে কিছু বলতে-বলতে আঙুল দিয়ে আমার কামরার দিকে দেখিয়ে দিলাম। অবাক; বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাবা। আমার মুখ দিয়ে কেবল বেরোল, আমার রুম…আমার রুম…
সমস্যাটা কী? তোমার রুমে কী হয়েছে?জানতে চাইলেন তিনি। সন্দেহ নেই ধরে নিয়েছেন বাদুড় বা অন্য কোনো ধরনের কীট-পতঙ্গ ঢুকেছে ,কামরাটায়। আর এখানেই আমি এই কাহিনি শুরু করেছি।
পাপা, জানালা গলে কেউ আমার কামরায় ঢুকতে চাইছে। বলতে-বলতে আবারও আতংকে শিউরে উঠলাম।
কোনো কথা না বলে কামরাটার দিকে দৌড়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর জন্য ভয় হতে লাগল আমার। অশুভ একটা কিছু দেখার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করে কামরাটার দিকে ফিরে তাকালাম।
কিন্তু রুমটা খালি।
যেভাবে রেখে গেছি সেভাবেই আছে, তবে জানালা গলে উঁকি দেওয়া হাতটা নেই। আমার হাতের বইটা পড়ে আছে মেঝেতে। দৌড়ে পালানোর সময় হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলাম ওটাকে।
আমার দিকে ফিরলেন বাবা। চোখে প্রশ্ন। সম্ভবত কোনো একটা ব্যাখ্যা আশা করছেন। কিন্তু বলার মত কিছু নেই আমার।
এই রোমাঞ্চের বইগুলো কল্পনার দৌড় বাড়িয়ে দিয়েছে তোমার। এখন থেকে ওগুলো দিনের বেলা পড়বে। ক্লান্ত, একই সঙ্গে কিছুটা রুক্ষ গলায় বললেন তিনি। মাথা ঝাঁকালাম, তবে চোখ আধ খোলা খালি জানালাটার দিকে। বাবার পরামর্শ মেনে বইটা সরিয়ে রাখলাম। তবে রাতে ঘুমালাম বাতি জ্বেলে।
ঘুম ভাঙল সকাল ছয়টার দিকে। মনে হলো, কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। মনে হলো যে ঘরের বাইরে গেটের কাছ থেকে আসছে। একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ। জানালার দিকে তাকানোর সাহস হলো না। গত রাতের কথা মনে পড়ে গেছে। বাবাকে চিৎকার দিয়ে ডাকার জন্য মনে-মনে প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছি।
এদিকে কণ্ঠটা আরও তীব্র হয়েছে। মনে-মনে নিজেকে একটা গাল দিলাম। আসলে আমি একটা নির্বোধ। সম্ভবত পরিচিত কেউই ডাকছে। হয়তোবা বুয়া কিংবা তার বাড়ির কেউ জানাতে এসেছে সে আজ সকালে কাজে আসবে না। তারপরও জানালার কিনারে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে কয়েক মিনিট লাগল।