সে কী বলছে বুঝতে পারলাম না। যখন তার কথার মানে জানতে চাইলাম তখন ডাইনিং রুমের খালি টেবিলটা দেখিয়ে দিল। একবার ভাবলাম প্রশংসাটা হজম করে ফেলব। তারপরই কৌতূহল জাগল। তাহলে কাজটা করল কে? পরে আব্দু-আম্মু ঘুম থেকে উঠলে জানতে চাইলাম তারা কেউ করেছে কিনা। তবে যা ভেবেছিলাম তাই, তারাও বইগুলো সরায়নি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এর মাধ্যমে রহস্যময় ঘটনাগুলোর শুরু হলো কেবল।
কিছু দিন পরের কথা। এক রাতে আব্দু-আম্মু আর বোনসহ বাড়ি ফিরছি। এসময়ই ওপরে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কালো, লম্বা একটা ছায়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। মাথার ওপরে হাত জোড়া, গ্রিল ধরে রেখেছে। বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম সম্ভবত ভাইয়া বাসায় আছে, আমাদের দেখছে সে। কিন্তু আমার বোন ওপরে তাকিয়ে বলল, কই, আমি তো কিছুই দেখছি না।
কিন্তু আমি তাকিয়ে ঠিকই তাকে দেখতে পেলাম। এটা বলতেই আম্মু বলে উঠলেন, আজে-বাজে কথা বোলো না। আলো না জ্বেলে রান্না ঘরের জানালায় কেন তোমার ভাই দাঁড়িয়ে থাকবে?
যখন বাসায় পৌঁছলাম সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রতিটি কামরা খুঁজে দেখলাম আমি আর আমার বোন, যদি ভাইয়া লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে মজা করার চেষ্টা করে এই ভেবে। সে বাসায় ফিরল বেশ রাত করে। কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করলে বলল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বের হয়েছিল। কয়েকদিন বাদে তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ঠিকই বলেছে ও।
আরেকদিনের কথা। বাসায় আমি একা। ফ্ল্যাটের মাঝখানের ডিভাইডারের দেরাজ পরিষ্কার করতে লাগলাম। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মনে হলো কে যেন আমাকে দেখছে। কী কারণে জানি না ওপরে তাকালাম। জায়গামতই তাকিয়েছি। কারণ মুহূর্তের জন্য ওটাকে দেখলাম। ডিভাইডারটার ওপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা গাঢ় ছায়া।
চেঁচিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে শোবার ঘরের দরজা দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হলো ওটা, যেন আমাকে ভয় পেয়েছে। এখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পাশের বাসায় চলে এলাম। ফিরলাম বাড়ির অন্যরা আসার পর। ঘটনাটি খুলে বলতেই আমাকে নিয়ে রীতিমত হাসাহাসি শুরু করল তারা। বলল সবই নাকি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।
তবে তাদের ধারণা পাল্টাল যখন আমার খালাতো বোন মালয়েশিয়ায় থাকা তার এক বান্ধবীকে নিয়ে আমাদের বাসায় এল। তার বান্ধবীটি একজন সাইকিক। আর এসেই বললেন এই বাড়িতে একটা অশরীরী আছে। অথচ তাকে আমার অভিজ্ঞতাগুলো বলিনি আমরা কেউই।
বললেন এখন ওটাকে দেখেছেন তিনি। হল রুমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য আমাদের চোখে কিছুই নজরে এল না। তারপর জানতে চাইলেন আমরা এমন কোনো নারীকে চিনতাম কিনা, যিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় সবসময় সাদা কাপড় পরতেন।
শুরুতে ভাবলাম আব্দুর ফুপুর কথা বলছেন। যখন আব্দুর বয়স কম ছিল তখন তিনিই তাঁর দেখাশুনা করতেন। কিন্তু তখনই জানা গেল বাবার ফুপু কখনোই সবসময় সাদা কাপড় পরতেন না। কাজেই রহস্যময় অশরীরীর পরিচয় বের করা গেল না। খালাতো বোনের বান্ধবীটি জানালেন আত্মাটা হল ঘরের অপর কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে সে সামনে আসতে নারাজ। পাছে আবার তিনি ওটাকে চলে যেতে বলেন। তবে এটাও বললেন আত্মাটা খারাপ স্বভাবের না। আর ওটা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু কে চায় বাড়িতে একটা আত্মা পুষতে, তা সে ভাল হোক, কি মন্দ?
তবে এটা ঠিক যতদিন ওই বাড়িতে ছিলাম সে আসলেই তেমন কোনো ঝামেলা করেনি। আমি ওটাকে দেখেছি সবচেয়ে বেশি। তবে ধীরে ধীরে বাড়ির অন্য সদস্যরাও অশরীরীটার অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করল। কারণ তাকে নিয়ে তাদেরও কিছু অভিজ্ঞতা হয়।
এক রাতে কিচেনের দিকে মুখ করে পড়ছিল আমার বোন।
বাড়ির বাকিরা তখন ঘুমিয়ে কাদা। এসময় শুনল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। শুরুতে খুব চাপা গলায়। যদিও সে নিশ্চিত ডাকটা শুনেছে, তারপরও এই বলে নিজেকে বোঝাল, এটা নিশ্চয়ই তার কল্পনা। আবার পড়ায় মন দিল সে।
তারপর আবার শুনল। এবার চড়া গলার, কর্কশ একটা কণ্ঠ। ঠিক পিছনেই ওটা। আর তার নাম ধরে ডাকছে। পিছনে না
তাকিয়ে এক ছুটে বেড রুমে চলে এল আমার বোন। রাতে ঘুমাল সে মাথার ওপর বেডশিট চাপিয়ে।
আব্দু-আম্মুও একসময় ওটার উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। মাঝে মাঝে রাতে হল ঘর থেকে আওয়াজ আসলেও এটাকে তেমন পাত্তা দেননি তাঁরা। কিন্তু এক রাতে এমন পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল যে সন্দেহ রইল না সেখানে কেউ আছে।
সে রাতে শোবার ঘরেই রইলেন তাঁরা। ওটা কী দেখতে বের হলেন না। কারণ আমরা সবাই গিয়েছিলাম আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। তার মানে বাড়িতে তারা ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়। আর তাই অযথা হল ঘরে গিয়ে অশরীরীর মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নেননি।
আমি সাইকিক নই। কিংবা আমার এ ধরনের কোনো ক্ষমতাও নেই। আর ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর এ ধরনের কিছু ঘটেছে কমই। তারপরও এখন যদি বলি অস্বাভাবিক কিছু টের পেয়েছি কংবা অদ্ভুত কোনো কাহিনি শুনেছি, আব্দু-আম্মু তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
৫. অশরীরীর আতংক
অশরীরীর আতংক
১৮৯১ সালের বসন্তে ফ্রান্সের লি পোর্টের এক বাড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় এক অশরীরী। খনি এলাকার কাছেই বাড়িটার অবস্থান। অনেক সময় এই এলাকাটায় হাজার দুয়েক লোকেরও সমাগম হয়। তবে প্রেতাত্মাটা নানান কাণ্ড-কীর্তি করে বেড়ালেও ওটাকে দেখেছে এমন দাবি করেননি কেউ। বাড়ির বাসিন্দাদের এভাবে পিটিয়েছে ওটা যে চেহারায় কালশিটে পড়ে গিয়েছিল কারো কারো। পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হয়। ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এমন অনেকের মুখ থেকে ঘটনাটা শোনেন তাঁরা। আঁটঘাট বেঁধে রহস্যের সমাধানেও নামে। মানুষের হাত থাকতে পারে এমন সব ধরনের সম্ভাবনা যাচাইবাছাই আর অনুসন্ধান করেন। কিন্তু এর পিছনে রক্ত-মাংসের কোনো মানুষ জড়িত এটা বের করতে ব্যর্থ হন।