বাড়ির কাঁচের আর রূপার জিনিসপত্র মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যেতে লাগল। মনে হয় যেন কেউ ওগুলো ছুঁড়ে ফেলেছে। এদিকে রাতে ঘরের চাকর-বাকররা বিভিন্ন কামরায় আটকা পড়তে লাগল। কে যেন বাইরে থেকে দোর আটকে দেয়। কাপড়-চোপড় ছেড়া অবস্থায় পাওয়া যেতে লাগল। অনেক দিন ব্যবহার করা হয় না এমনকামরার বিছানার চাদরও এলোমেলো এমনকি কখনও কখনও বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ছোট্ট গেনের পছন্দের অন্য খেলনাগুলো বর্বরের মত কে যেন ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলে। আর গভীর রাতে শোনা যায় শরীরে শির শির করা ফিকফিক হাসি।
তবে দোষ পড়তে লাগল সব পিচ্চি গেনের ঘাড়ে। বাবা-মা খুব বকা-ঝকাও করলো তাকে। তবে প্রতিবারই সে সাফাই গায়, রবার্ট ওটা করেছে। যদিও তার এই কৈফিয়তে মন টলে না বাবা-মার। পুতুল নড়তে-চড়তে শিখে একটার পর একটা অকাণ্ড ঘটাচ্ছে এটা কে-ই বা বিশ্বাস করবে? এদিকে এসব আলামতের পর বাড়িতে কাজের লোকদের মন রাখতে প্রচুর অর্থ গুণতে হয় অটোদের। একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরা চেষ্টা করলেন সমস্যা সমাধানের। গেনের এক দাদীর পরামর্শে রবার্টকে গেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চিলেকোঠার একটা বাক্সে বন্দি করে রাখা হলো। তার পরের রাতেই বুড়ো মহিলাকে তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ধারণা করা হলো স্ট্রোক হয়েছে তাঁর। তবে ভদ্রমহিলার অপ্রত্যাশিত এই মৃত্যুর পরপরই রবার্ট আবার ফিরে পেল গেনের সঙ্গীর জায়গা।
তারপর থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ওটা থাকতে লাগল এই বাড়িতে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরও এই বাড়িতেই থাকল গেনে। এমনকী বেশ বয়স হওয়ার পরও দেখা গেল ছোটবেলার সঙ্গী পুতুলটাকে কাছছাড়া করছে না সে। পরে গেনের ঘনিষ্ঠরা মত প্রকাশ করেন পুতুলটাই প্রভাব খাটিয়ে গেনেকে ওটাকে ছাড়তে দেয়নি।
এদিকে বালক বয়সে বাড়ির কোনার যে কামরাটায় গেনে থাকত সেটা এক সময় রবার্টের আস্তানায় পরিণত হয়। ওখান থেকে সময়-অসময়ে ফিক ফিক আর পাগলাটে হাসি ভেসে আসতে লাগল। একে-একে চাকর-বাকরেরা আর্টিস্ট হাউস ছাড়তে লাগল। এমনকী সবচেয়ে দুঃসাহসী, লোকটিকেও এখানে খুব বেশিদিন রাখা যায় না। শেষমেশ দেখা গেল বাড়িতে মাত্র দুজন কাজের লোক আছে। তারা স্বামী-স্ত্রী। কয়েক ঘণ্টার জন্য আর্টিস্ট হাউসে আসে তারা। এর মধ্যে স্ত্রীটি গেনের জন্য রান্না-বান্না করে। আর স্বামীটি বাড়ির টুকটাক কাজ করে। তাও দুজনেই সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাই ঘটুক না কেন বাড়ির কোনার ওই কামরাটার কাছে তারা ঘেঁষে না। এমনকি গেনে বকা-বাদ্য করেও ওটায় ঢুকাতে পারেনি তাদের।
একপর্যায়ে বিয়ে করল গেনে অটো। তবে গোড়া থেকেই সুখের হলো না দম্পতির জীবন। শুরু থেকেই অপার্থিব একটা ছায়ার মত তাদের দাম্পত্য জীবনে লেগে রইল রবার্ট। যেখানেই যাবে পুতুলটাকে সঙ্গী করবে গেনে। খাবার টেবিলে একটা চেয়ার বরাদ্দ থাকে, ওটার জন্য। শুধু তাই না, নববিবাহিত দম্পতির শয্যার পাশেও তার প্রিয় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় পুতুলটাকে। স্বাভাবিকভাবেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরল। আর এই পরিবেশে থাকতে-থাকতে একসময় উন্মত্ত আচরণ শুরু করল মিসেস অটো। তারপর একদিন রহস্যময়ভাবে মারা গেল। লোকে বলে এখনও আর্টিস্ট হাউসে ঘুরে বেড়ায় তার প্রেতাত্মা।
একসময় মৃত্যু হলো গেনে অটোর। কিছু দিনের জন্য বাড়িতে একা হয়ে গেল রবার্ট। নতুন মালিক বাড়িটায় আসার পর আবার রবার্টের জায়গা হলো চিলেকোঠা একটা বাক্সে। কিন্তু প্রথমবারের মতই এই ব্যবস্থায় খুশি হতে পারল না অশুভ পুতুলটা। রাতগুলো দুর্বিষহ করে তুলল সে পরিবারটির জন্য। বাড়ির এখানে-সেখানে তার উপস্থিতির নজির রাখতে শুরু করল। ঘটাতে থাকল একটার পর একটা অঘটন। তারপর রান্নাঘরের ছুরি হাতে যখন ওটা নতুন মালিক-মালিকানের বিছানার কাছে হাজির হলো, আর ফিক ফিক করে হাসতে লাগল, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তাদের। দেরি না করে বাড়ি ছাড়লেন তারা। আর রবার্টের ঠাই হলো নতুন ঠিকানা, ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের ইস্ট মার্টেলো জাদুঘরে। যেখানে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাকে।
এখনও আর্টিস্ট হাউসে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা বলেন, রবার্ট সম্ভবত তার নতুন বাড়ির সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি। কারণ যেসব খালি ঘরে ট্যুরিস্ট গাইডরা তাদের ভয়ে নিতে যেতে চান , সেসব ঘর থেকে প্রায়ই খিলখিল হাসি আর ছোট্ট পায়ের কারও হেঁটে বেড়ানোর শব্দ শুনতে পান। কখনও কখনও ছোট শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় কোনার কামরাটার জানালা গলে রবার্টকে উঁকি মারতে দেখে ভয়ে ছুটে পালায়।
তবে ইস্ট মার্টেলো জাদুঘরে এভাবে তাকে সাজিয়ে রাখায় সে যে ক্রুদ্ধ তার প্রমাণ রবার্ট রেখে চলেছে অবিরত। তাকে দেখেই শিউরে ওঠেন পর্যটকরা। এক নারী পর্যটক তার চোখের সামনে পুতুলটার মুখের ভঙ্গী দেখে আঁতকে ওঠেন। ঠিক আগের মুহূর্তে ওটা হাসছিল, তারপরই বিরক্ত হয়ে ভ্রুকুটি করে রাখল।
আবার কোনো কোনো পর্যটক এমনও দাবি করেছেন বিখ্যাত পুতুলটা ছবি তোলার পর কালো ফ্রেম ছাড়া আর কিছুই পাননি। রবার্ট যে জায়গাটায় এখন আছে সেখানে আলোর অবস্থা বেশ খারাপ। এত কম আলোতে ছবি তোলা এমনিতেই কঠিন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জায়গাটাকে আলোকিত করার নানা ধরনের ব্যবস্থা নিলেও কী এক অজানা কারণে সুবিধা হয়নি। আবার এ ধরনের গুজবও আছে ছবি তোলার আগে পুতুলটার কাছে। ভদ্রভাবে অনুমতি চাইতে হয়। তা না হলে যে ছবি তুলবে তার উপর নেমে আসে রবার্টের অভিশাপ। আর এখনও জাদুঘরে রাতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে কিংবা কিছু পড়ে গেলে বলা হয়, রবার্ট এটা করেছে। রাতে শেষ ব্যক্তি হিসাবে জাদুঘর ছাড়তে চায় না কোনো কর্মচারীই।