হিমান বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মনে-মনে। কিন্তু কালো জাদুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই সামনে। কাজেই বিনোদসহ পটটা নিয়ে বের হলো রাতের অভিযানে। নদীর ধারটা রাতের বেলা একেবারেই নির্জন থাকে। তারপর আবার দু-পাশের গভীর জঙ্গল, এমনকী প্রচণ্ড সাহসী লোকটির আত্মাও কাঁপিয়ে দেবে। কাজেই দুরুদুরু বুকে পাথরটা খুঁজে বের করল তারা। তারপর ওটার ওপরে পটটা রেখে গুঁড়িয়ে দিল ওটাকে হিমান। ঘুরে মাত্র কয়েক কদম এগিয়েছে এমন সময় একটা অট্টহাসির আওয়াজ শুনল পিছনে। তারপরই মনে হলো কে যেন পিছন থেকে ডাকছে তাদের।
হতচকিত হয়ে হিমান প্রায় মাথা ঘুরিয়ে ফেলেছিল কী ঘটেছে দেখার জন্য। কিন্তু বিনোদ এই পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে। হিমানের কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে-আস্তে তাকে দূরে সরিয়ে আনতে লাগল অভিশপ্ত জায়গাটি থেকে। বাড়ি পৌঁছেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল তারা। তারপর তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল। এখন নির্ভার। কারণ গতদিনের কাজ ঠিকমতই সমাধা করেছে, একেবারে ওঝা যেমন যেমন বলেছেন ঠিক তেমন তেমন। অর্থাৎ তাদের সমস্ত সমস্যারও সমাধান হয়ে গেছে। খুশি মনে বুড়ো ভদ্রলোকের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো তাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
কিন্তু বাড়িটাতে পৌঁছেই চমকে উঠল তারা। কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। বাড়িতে ঢোকার পর ওঝার ছেলের সঙ্গে দেখা হলো তাদের। এমনিতে হাসি-খুশি লোকটাকে খুব বিষণ্ণ দেখে অবাক হলো। তারপরই জানালেন তার বাবা, বৃদ্ধ ওঝা গত রাত সাড়ে বারোটায় মারাত্মক একটা হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। এর কিছুক্ষণ পরেই মারা যান তিনি।
হিমান আর বিনোদ এতটাই ধাক্কা খেয়েছে যে কিছু বলতে পারল না। মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে এল। তবে সন্ধ্যা নামার পরপরই শুরু হলো আবার সেই পাথর বৃষ্টি। চলতেই থাকল পরের দিনগুলোতে। ওঝার নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছুই করেছে তারা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। তারপর আবার ওঝার হঠাৎ মৃত্যুতে দারুণ ভেঙে পড়ল হিমান আর বিনোদ। খামারের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলল তারা।
তবে এখান থেকে যাবার সময় একটা জিনিসই বার-বার তাদের কুরে-কুরে খাচ্ছিল। ওঝার মৃত্যুটা কি নিছক স্বাভাবিক ঘটনা, নাকি ওই কালো জাদুকরের সঙ্গে লাগতে যাওয়াই কাল হয়েছে তার? ভদ্রলোকের খুব ভালই জানা ছিল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে চলেছেন। তারপরও অসহায় দুই যুবককে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। তবে কি তাঁর তুলনায় অনেক শক্তিশালী কোনো শক্তির বিরুদ্ধে লাগতে যাওয়ার মূল্য দিতে হয়েছে?
বারান্দায়, আমার অপেক্ষায়
কাহিনিটা শুনিয়েছেন সিংগাপুরের পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক এক অফিস সহকারী। গল্পটা বরং তাঁর মুখ থেকেই শুনি।
ফ্ল্যাটে বেশ রাত করে ফেরার অভ্যাস আমার। আর কখনও এটা নিয়ে কোনো ঝামেলায়ও পড়তে হয়নি। তবে একদিন রাত এগারোটার দিকে এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার আগে সেদিন শহরের. অপর পাশের এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে গিয়েছি। সন্ধ্যায় আবার আমার স্ত্রী, বাচ্চাদের নিয়ে তার বাবার বাড়িতে গিয়েছে। বাসাতে তাই কেউ নেই।
বেডক সংরক্ষিত এলাকায় এসে বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর যে ব্লকে থাকি সেদিকে চলে-যাওয়া রাস্তা ধরে রওয়ানা হলাম। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় পথে খুব একটা লোকজন নেই দেখে অবাক হলাম না। তবে আমার সামনে একটা মেয়ে হাঁটছে। মেয়েটার লম্বা চুল, আর চমৎকার কাঠামো পিছন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই একজন পুরুষ হিসাবে মনে কৌতূহল জেগে উঠল। পিছন থেকে যেমন দেখা যাচ্ছে সামনে থেকেও কি সে এমন সুন্দর? তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালালাম।
মেয়েটাকে পেরিয়ে গিয়েই চটজলদি একবার পিছন ফিরে চাইলাম দেখার জন্য। মন্দ না। তবে চেহারাটা কেমন ফ্যাকাসে। যেহেতু সামনে চলে এসেছি তাই দ্রুত আমার ব্লকের দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাছে আবার আমি তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছি ভেবে মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
যখন আমার ব্লকে পৌঁছলাম তখন পিছনে মেয়েটার আর কোনো নাম নিশানা পেলাম না, সামনে তো নয়ই। বাড়ির সামনে এসে লিফটের অপেক্ষায় না থেকে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ তলায় ওঠা স্থির করলাম।
পাঁচ তলায় পৌঁছে সিঁড়ির কোনা থেকে সামনে তাকাতেই তাকে দেখতে পেলাম। এটা সেই মেয়েটা, যে আমার পিছনে ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে এখন।
আমার দিকে তাকিয়ে হাসল সে।
উল্টো ঘুরেই দৌড়তে শুরু করলাম। পাশের ব্লকে বন্ধুর বাসায় পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত থামলাম না। সেই রাতে আর বাড়ি ফিরলাম না।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এমন ঘটনা জীবনে আর ঘটেনি।
পথ হারানো আত্মা
এই কাহিনিটা শোনান সিংগাপুরের এক তরুণী ক্লার্ক। তাঁর জবানীতেই পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো এটা।
ভূত-প্রেতের ব্যাপারে আমার বড় ভাইয়ের কখনওই খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এসবে ওর বিশ্বাস ছিল বলেও মনে হয় না। তারপরই তার জীবনে ঘটল অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।
বছর দুয়েক আগের কথা। একদিন বাসায় ফিরল সে হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে। কপালে চিন্তার রেখা। রাতে খাবার সময় এমনকী তার পরেও তাকে বেশ বিষণ্ণ দেখাল। ঘুমানোর আগে আমি আর আমার বোন জানতে চাইলাম এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তাকে? শুরুতে কিছু বলতে চাইল না। তবে পরের দিন রইল কেন যেন মনে হচ্ছে দুটো চোখ তার মাথার পিছনে সেঁটে আছে। তার সব কিছুর ওপরই নজর রাখছে ওই দুটো চোখ। আমি আর আমার বোন হেসে উড়িয়ে দিলাম কথাটা। বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ঠাট্টা-মস্করাও করলাম। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম এটা মোটেই হেলাফেলা করার মত ব্যাপার নয়।