মুম্বাইয়ের কিনারা ঘেঁষে কালিয়ান নামের একটি জায়গা আছে। তার কয়েক মাইলের মধ্যে একটা গ্রামে মাঝারি আকারের একটা জায়গা বাছাই করে তারা। আর মুরগীর খামার এতটাই পরিচিত যে যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয় তাদেরও জানা আছে এ ধরনের খামার চালানো কী ঝক্কির ব্যাপার। যত্ন-আত্তিতে -একটু এদিক-সেদিক হলেই দেখা যাবে খামারের বারোটা বেজে গেছে। নিয়মিত খাবার, পানি দিতে হবে। তাও পরিমিত মাত্রায়। রোগ-বালাই আর মড়ক থেকে রক্ষার জন্য ওষুধও দিতে হবে পুরো নিয়ম মেনে। আর এটা এমন এক কাজ যেখানে পুরো দায়িত্ব ভাড়া করা লোকদের হাতে দিয়ে দিলে সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনা ষােলো আনা।
কাজেই হিমান স্ত্রীসহ খামারেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তার স্ত্রী আবার এসময় বেশ কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্ত্রীকে নিয়ে এখানে যাওয়াতে আপত্তি তুলল পরিচিত অনেকেই। বলা হয় এ ধরনের খামারে অনেক সময়ই অশুভ শক্তির আনাগোনা থাকে। তারপর আবার একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য এটা আরও বিপজ্জনক জায়গা। তবে হিমানের স্ত্রী দারুণ সাহসী মেয়ে। কাজেই এসব কুসংস্কারে কান না দিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকা স্থির করল সে।
খামারের কাজ সাহায্য করার জন্য তিন-চারজন স্থানীয় গ্রামবাসীকে নিয়োগ দিল হিমান আর তার বন্ধু বিনোদ। এদের মধ্যে দুজন মুসলমান। বলা হয় এই এলাকার মুসলমানরা এ ধরনের খামারের কাজে দারুণ দক্ষ।
শুরুর কয়েকটা মাস ঠিকঠাকমতই চলল সব কিছু। তারপর হঠাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করল পরিস্থিতি। সব ধরনের তদারকির পরেও প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যায় মুরগী মরতে লাগল। কোনো রোগ-বালাইয়ের চিহ্নও পাওয়া যাচ্ছে না। মুরগীগুলোকে নিয়মিত খাওয়ানো-দাওয়ানো হচ্ছে, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সর্বোচ্চ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখা হয়েছে। কিন্তু দিনকে দিন অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। এমনকী পশু চিকিৎসকও হঠাৎ এভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যুর কোনো কারণ আবিষ্কারে ব্যার্থ হলেন।
এদিকে হিমানের স্ত্রীর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল এখানে কোনো অশুভ শক্তির উপস্থিতি আছে। আর ওটা তার বাচ্চাটার ক্ষতি করতে চায়। মাঝে-মাঝেই মূৰ্ছা যেতে লাগল সে। অথচ হিমান সবসময়ই দেখে এসেছে তার স্ত্রী সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রী না। এই পর্যায়ে হিমানের স্ত্রী আপাতত খামার ছেড়ে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠতে রাজি হলো। ঠিক হলো বাচ্চাটা না জন্মাননা পর্যন্ত খামারে আসবে না সে।
কোনো কোনো মানুষ বিশ্বাস করে অন্তঃসত্ত্বা নারী আর বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের উপস্থিতি অশুভ শক্তি আর আত্মাদের উৎসাহী করে তোলে। কারণ এ ধরনের মেয়েদের মানসিক অস্থিরতা অশুভ শক্তিদের সুবিধা করে দেয়। কাজেই হিমান আশা করল তার স্ত্রী খামার ছাড়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
কিন্তু হলো উল্টোটা। নতুন ধরনের একটা ঘটনা শুরু হলো। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে-সঙ্গে বিপুল পরিমাণে পাথর পড়তে থাকল বাড়ির উপর। পাথরগুলোর উৎস কী তাও বোঝা গেল না, কারণ মনে হয় যেন ওগুলো আকাশ থেকে পড়ছে। গ্রামবাসীরা এগিয়ে এল তাদের সাহায্যে। আশপাশের ঝোপঝাড়ে আর গাছে লুকিয়ে থেকে পাথরের রহস্যভেদে তৎপর হলো সবাই। এমনকী সার্চ লাইট মারা হলো আকাশেও। কিন্তু পাথরগুলো মনে হলো যেন শূন্য থেকেই গজিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশকে জনানো হলো বিষয়টা। কিন্তু অতিপ্রাকৃত শক্তির বিরুদ্ধে পুলিশদেরই বা কী করার আছে? তারাও ব্যর্থ হলো এটা থামাতে।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো পাথরগুলো কারও শরীরে এসে লাগে না। এমনকী যদি পাথর বৃষ্টির মাঝখানেও দাঁড়িয়ে থাকেন আপনাকে বাঁচিয়ে চারপাশে পড়তে শুরু করবে ওগুলো।
শেষমেশ আর কোনো উপায় না দেখে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কারও সাহায্য নেওয়া স্থির করল হিমান আর বিনোদ। দমবিভলির একজন বিখ্যাত ওঝার কথা শুনেছে তারা। ভূত, আত্মা এসব নামাতে নাকি ওস্তাদ ভদ্রলোক। পরোপকারী হিসাবেও সুনাম আছে তাঁর। মানুষকে সাহায্য করার বিনিময়ে কোনো অর্থ-কড়িও নেন না।
হিমান আর বিনোদের কাছ থেকে সব কিছু শুনে জ্ঞানী ওঝা বুঝে গেলেন এটা শক্তিশালী কোনো কালো জাদুকরের কাজ। কিন্তু হিমান আর বিনোদ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল বুড়ো ভদ্রলোকটি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারপরই তিনি বললেন, এই শক্তিটি এত ক্ষমতাশালী যে তাঁর পক্ষে এর সঙ্গে টক্কর দেওয়া সম্ভব নয়। ভাল হয় যদি তারা অন্য কারও সাহায্য নেয়।
কিন্তু হিমানের বার-বার অনুরোধে টলে গেলেন বুড়ো ওঝা। আগামীকাল আসতে বললেন তাদের। পরের দিন যখন এল তখন একটা পাত্র দিলেন। কালো রং করা পাত্রটা লাল কাপড়ে ঢাকা। বেশ ভারি। ওঝা তাদের বললেন এটার মধ্যে যে জিনিসটা আছে আশা করা যায় সেটি অশুভ আত্মাটাকে বশ মানাতে পারবে।
কালিয়ান থেকে মুরগীর খামারের দিকে যেতে হলে একটা নদী পড়ে। নদীর ওপরে একটা সেতু আছে। সাধারণত রাতের বেলা খুব দরকার না হলে কেউ এই নদীর তীরে ভিড়ে না। বলা হয় এই জায়গাটাতে কালো জাদুর চর্চা হয়। রাতে সেতু পেরোনোর সময় অনেক সময়ই রহস্যজনকভাবে যানবাহনে গোলমাল দেখা দেয়।
বুড়ো ভদ্রলোক হিমান আর তার বন্ধুকে রাত বারোটার পর পটটা নদীর তীরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নদীর তীরে একটা বড় পাথর আছে, যেটায় রেখে সাধারণত নারকেল ভাঙা হয়। ওঝা পটটা ওই পাথরে ভেঙে সঙ্গে-সঙ্গে চলে আসতে বলেন। সতর্ক করে দেন কোনো অবস্থাতেই যেন ঘুরে কী ঘটেছে দেখার চেষ্টা না করে। আর জায়গাটা ছেড়ে আসার সময় দৌড়নো চলবে না, জোর কদমে হেঁটে আসতে হবে।