ফাদার টম কথা বলা বন্ধ করতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা কামরাটা। তারপর শোনা গেল মেরির কান্নার শব্দ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কাঁদতে-কাঁদতেই সে বলল, আমিই নাবিক ছেলেটার হতভাগ্য আত্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে কেবল তার মাকে খুঁজছিল। ইস, আমি যদি জানতাম…
২. ব্রাউন লেডি
ব্রাউন লেডি
গত দেড়শো বছরে ইংল্যাণ্ডের নরফোকের রেইনহ্যাম পার্কে ব্রাউন লেডি বা বাদামি বসনাকে দেখা গিয়েছে অনেকবার।
সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠা-নামা করে সে, কখনও করিডর ধরে হেঁটে বেড়ায়। তার পরনে থাকে বাদামি-হলুদ একটা পোশাক আর গলায় পশমের গলাবন্ধ। তার চোখের জায়গায় থাকে অন্ধকার গর্ত, মুখটা মোমের মত সাদা। এমনিতে কোনো কথা বলে না, কারও ক্ষতি করে না, এমনকী কিছু চায়ও না। তবে কখনও কখনও তার ঘুরে বেড়াবার মধ্যে অশুভ, ভয়ঙ্কর কী যেন একটা থাকে, এমনকী তাকে দেখে সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষটিরও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
রেইনহ্যাম ছিল মারকুইজ অব টাউনশেদের বাড়ি। খুব প্রাচীন একটা বাড়ি এটি। ১৮৩৫ সালের দিকে এটা কিনে সংস্কার করান টাউনশেন্ডরা। এ উপলক্ষে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেন লর্ড এবং লেডি চার্লস টাউনশেণ্ড। এদের একজন ক্যাপ্টেন ফ্রেডেরিক মারিয়াট। ছোটদের জন্য গল্প লিখে তখন খুব নাম কামিয়েছেন ভদ্রলোক। ফ্রেডেরিক পৌঁছার পরপরই লর্ড চার্লস তাঁকে এক পাশে টেনে এনে নিজের স্টাডির দিকে নিয়ে চললেন।
দুজনের জন্য গ্লাসে মদ ঢেলে কথা বলা শুরু করলেন. লর্ড চার্লস। মুখে চিন্তার ছাপ। ফ্রেডেরিক, এখানে কিছু একটা সমস্যা তৈরি করছে। তোমার সাহায্য দরকার আমার। বাড়িতে একটা ভূত আছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এটাকে পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু কোনো চাকর-বাকর কিংবা অতিথিই দু-চার রাতের বেশি থাকতে পারে না এখানে। তারা ব্রাউন লেডি নামে পরিচিত একজন মহিলাকে দেখেছে। এই তথাকথিত ভূত নাকি বারান্দা এমনকি শোবার ঘরগুলোর ভিতরে আর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়।
চার্লস, তিরস্কার করলেন ক্যাপ্টেন, এ ধরনের আজগুবি গল্পে তুমি কেন বিচলিত হচ্ছ এটা মাথায় আসছে না আমার। আমি ওসব ভূত, প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। যদি আসলেই কাউকে দেখা যায়, তবে ধরে নিতে পার কেউ তোমার সঙ্গে চালাকি করছে। তুমি কিনে নেওয়ার আগে কিছুদিন বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। ঠিক না?
হ্যাঁ।
এই এলাকার একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমি জানি, আবার কথা বলা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট, এদিকটায় বেশ ভাল পরিমাণ চোরাচালানি আর চোরাশিকার হয়। এসব চোরাচালানির লুকানোর জায়গা হিসাবে যে বাড়ি আর আস্তাবলগুলো ব্যবহার করা হত এটি সম্ভবত তার একটা। এখন তোমাদের উপস্থিতির কারণে একটা নিরাপদ আত্মগোপনের জায়গা হাতছাড়া হওয়ার অবস্থা হয়েছে তাদের। তারাই গ্রামে ভূতের গল্প ছড়িয়ে তোমাকে তাড়াতে চাইছে।
লর্ড চার্লস উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ। আমার ধারণা তুমি আসল জায়গায় হাত দিয়েছ। তুমি জান আমার কুকুর আছে। আর এদের চেঁচামেচিতে রাতে এই বাড়ি কিংবা আস্তাবলের ধারে-কাছে ঘেঁষা কঠিন কারও কারও জন্য। তারাই আমাকে তাড়াতে চাচ্ছে। সন্দেহ নেই চোরাচালানি কিংবা চোরাশিকারীদের বানানো চরিত্র এই বাদামি বসনা নারী।
কোন্ কামরাটায় এই মহিলাকে দেখেছে লোকেরা? হালকা চালে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। তার বুদ্ধির প্রতি বন্ধুর আস্থা দেখে মনে-মনে খুশি হয়ে উঠেছেন।
আস্তাবলের দিকে মুখ করা দ্বিতীয় তলার একটা কামরা ওটা, জবাব দিলেন লর্ড চার্লস। বেশ বড়সড়, চমৎকার একটা কামরা এটা। চারপাশে সিডার কাঠের প্যানেল দেওয়া। দেয়ালে একজন মহিলার প্রতিকৃতি আছে। তার পরনে একটা বাদামিহলুদ পোশাক, গলায় একটা গলা বন্ধনী। সম্ভবত এটাই সেই ব্রাউন লেডি, যার কথা লোকে বলে।
তাহলে তোমার অনুমতি পেলে আমি সেখানে রাতে ঘুমাতে চাই, ঘোষণা করলেন ক্যাপ্টেন। এখান থেকে আস্তাবলের দিকে চোখ রাখতে পারব। আর তোমার ওই ব্রাউন লেডি যদি চেহারা দেখায় তার কুশলও জিজ্ঞেস করতে পারব, যদিও সে আসবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার।
কোনো সমস্যা নেই। তোমার জন্য কামরাটা ঠিক করে দিতে বলছি। মনে হয় না রাতে কোনো অনাহূত অতিথি ব্যাঘাত ঘটাবে তোমার ঘুমে।
বালিশের নীচে গুলি ভরা একটা রিভলভার রেখে. পর পর দুরাত ভুতুড়ে কামরাটায় কাটালেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই নজরে এল না। তৃতীয় রাতটাই এখানে তাঁর শেষ রাত। ক্যাপ্টেনের ধারণা এ রাতটাও কাটবে ঘটনাবিহীনভাবে।
মাঝরাতের ঠিক আগে। হাতে মোমবাতি নিয়ে, বাদামী সিল্কের পোশাক পরা তরুণী মহিলার প্রতিকৃতিটা পর্যবেক্ষণ করছেন ক্যাপ্টেন। মহিলার চেহারায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মাথাটা একবার ঝাকিয়ে ভূতের চিন্তা-ভাবনা মন থেকে বিদায় করে এক পা পিছিয়ে এলেন। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠল। এখান থেকে মোমবাতির আলো যে ছায়া তৈরি করছে তাতে বদলে গেল চেহারাটা। ওটাকে এখন সাধারণ আর নিস্পাপ মনে হচ্ছে না। বরং ভীতিপ্রদ আর পৈশাচিক লাগছে। চোখ দুটো কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে, চামড়ার ভেতর থেকে হাড় ফুটে বেরোচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কেন যেন মনে হলো তিনি একটা খুলির দিকে তাকিয়ে আছেন।