টমের মার জায়গায় নতুন একটা মেয়ে কাজ নিল মি. হাওয়ার্ডের বাসায়, নাম মেরি স্নেইক।
কয়েক মাস পরের ঘটনা। তারিখটা ১৮৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। কেউ একজন মি. হাওয়ার্ডের বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাল। মেরি স্লেইক গেল দরজা খুলতে। মিসেস হাওয়ার্ড ছিলেন উপরে তার বেডরুমে। দরজা খোলার শব্দ পেলেন, তারপরই কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কথাবার্তা চলল অল্প কিছুক্ষণ, কিন্তু আগন্তুকের কণ্ঠটা কানে আসতেই কেমন যেন পরিচিত ঠেকল মিসেস হওয়ার্ডের।
আমি এটা চিনি, নিজেকে বললেন তিনি, হঁা, সন্দেহ নেই এটা টম পটারের কণ্ঠ।
দরজা বন্ধ হয়ে যেতে নীচে হলে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছিল, মেরি?
ওপরে তার বেডরুমে উঠে এল মেরি। জাহাজে কাজ করা একটা ছেলে, ম্যাম। তার মাকে খুঁজছিল। আমি বলেছি তাঁকে আমি চিনি না, তারপর ছেলেটাকে চলে যেতে বলি।
সে দেখতে কেমন ছিল? চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হাওয়ার্ড।
পোশাক-আশাকে খুব ফিটফাট। তবে খালি পায়ে ছিল। আমি তাকে দেখলে আবার চিনতে পারব। তার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, চোখে-মুখে হতাশার একটা ছাপ ফুটে উঠেছিল।
সে কি কিছু বলেছে?
তেমন কিছু না, ম্যাম। যখন আমি তাকে বললাম তার মা এখানে নেই তখন কেবল মাথায় হাত রেখে বলল, এখন আমি কী করব?
ধন্যবাদ, মেরি। আবার ও আসলে আমাকে ডাক দিতে ভুল করবে না।
মি. হাওয়ার্ড বাড়ি ফিরলে দেরি না করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললেন তাঁর স্ত্রী। তারপর যোগ করলেন, আমার মনে হয় আবার জাহাজ থেকে পালিয়েছে সে।
মাথা ঝাঁকিয়ে মি.হাওয়ার্ড বললেন, টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব! কখনওই ঝামেলা ছাড়া থাকতে পারল না ছেলেটা।
ছেলেটা এভাবে বাড়ির দুয়ার থেকে ফিরে যাওয়াতে অপরাধবোধে ভুগছিলেন হাওয়ার্ডরা। তারা তাই টমের মার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে টমের দেখা হয়েছে কিনা জানতে। যখন তিনি জানালেন টমের সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই, আরও হতাশ হয়ে পড়লেন তারা। সম্ভবত ছেলেটার কোনো ধারণাই নেই তার মা কোথায় আছে। আর এখন নিশ্চয় লণ্ডনের পথে-পথে ঘুরছে।
মি. হাওয়ার্ড ফাদার টডের সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনাটা শুনে অবাক হলেন তিনিও। টম আবার জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছে এটা বিশ্বাস হয় না আমার, ঘোষণা দিলেন তিনি। মাত্র মাস দুয়েক আগে ওর একটা চিঠি পেয়েছি। তখনও সেখানে চমৎকার ছিল সে। আমার মনে হয় আপনাদের বাড়িতে কাজ করা সেই মেয়েটা, মেরির সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার আমার। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত আসলেই ছেলেটা টম পটারই ছিল কিনা।
আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি। বলে বেরিয়ে গেলেন মি. হাওয়ার্ড।
মেরি এসে পৌঁছতেই পাদ্রী তাকে ডজন খানেক ছেলের ছবি দেখালেন, যাদের মধ্যে টমও ছিল। তারপর বললেন, আমি দেখতে চাই সেদিন যে ছেলেটা এসেছিল তাকে তুমি এদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে পার কিনা।
একটু সময় তাকিয়েই একটা ছবি তুলে নিয়ে মেয়েটা বলল, এটাই সেই ছেলেটা। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি।
আর ছবিটা টম পটারেরই। অর্থাৎ এখন আর কোনো সন্দেহ রইল না সেদিনের সেই রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ না টম পটার। তাহলে কোথায় গেল সে? কেন আর ফিরে এল না? আর যদি কেউ তাকে তার মায়ের ঠিকানা দিয়ে থাকে, তবে সে কেন সেখানে গেল না? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।
বেশ কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। তারপর অক্টোবরের এক দিনে নৌ সদরদপ্তর থেকে একটা চিঠি এল ফাদার টডের কাছে। খাম ছেড়ার সময় পাদ্রী মনে-মনে বললেন, সন্দেহ নেই টম পটারের খবর আছে। ছেলেটা এখন কোথায় আছে?
চিঠিটা পড়তে-পড়তে হাঁফাতে লাগলেন পাদ্রী, চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে তাঁর। তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।
ভাগ্য ভাল তিনি যখন পৌঁছলেন তখনও বেরিয়ে পড়েননি মি. হাওয়ার্ড। মিসেস হাওয়ার্ড আর মেরিকে ডেকে আনা হলো। তারপর চারজন জড় হলেন বাড়ির স্টাডিতে।
আপনারা কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন? হঠাৎই জানতে চাইলেন পাদ্রী।
চমকে উঠলেন তাঁরা। তারপরই মি. হাওয়ার্ড বলে উঠলেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনি কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?
তাঁর কথায় কান না দিয়ে পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হাওয়ার্ড, আপনি?
স্বামীর দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিলেন ভদ্রমহিলা, আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি। তবে তবে ওরা থাকতেই পারে।
সবশেষে মেরির দিকে তাকালেন পাদ্রী, আর তুমি, মেরি? হ্যাঁ। সোজাসাপ্টা জবাব দিল মেয়েটা।
তাহলে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হবে না, যদি আমি বলি একটা প্রেতাত্মার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে।
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল মেয়েটা। মি. হাওয়ার্ড এবার পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?
টম পটার কবে এসেছিল এখানে? জিজ্ঞেস করলেন পাদ্রী।
ওটা ছিল সেপ্টেম্বরের আট তারিখ। জবাব দিলেন মিসেস হওয়ার্ড।
এর দু-দিন আগেই জ্যামাইকায় মারা গেছে টম।
মি. হাওয়ার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর স্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, আর মেরি কাঁদতে শুরু করল।
পাদ্রী নৌ দপ্তরের চিঠিটা নাড়িয়ে বললেন, চিঠিতে বলা হয়েছে, রণতরী ডরিসে বড় রকমের একটা দুর্ঘটনায় পড়ে টম। সেটা ছিল ১৮৬৬ সালের ২৪ জুলাই। এতে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয় ছেলেটা। কয়েকটা সপ্তাহ যমে-মানুষে টানাটানি হয় তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ মারা যায়। মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও মাকে দেখতে চাচ্ছিল সে। তারপর সবাইকে এটা হজম করার একটু সময় দিয়ে ফাদার টম আবার বলতে শুরু করলেন, এই বাড়িতেই টম তার মাকে শেষ দেখেছে। আর এই কারণেই টমের প্রেতাত্মা এখানে আসার আকর্ষণ অনুভব করেছে। একটা আত্মা কেবল সেসব ঘটনা জানে যা সে জীবদ্দশায় জানত। বেঁচে থাকা অবস্থায় সে কখনওই জানত না তার মা বাসা বদল করেছে। আর তাই এখানে ফিরে এসেছে, প্রিয় মাকে শেষবারের মত দেখবার জন্য…