১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের দারুণ গরম একটা দিন। হঠাৎই কর্ডোভার বেলমিজ গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে খুব শশারগোল শোনা গেল। এই এলাকাটা পড়েছে স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশে। বুড়ি দাদি ফিলোমেনা রান্না করছেন। রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে আছে ছেলে-মেয়েরা। আপাত কোনো কারণ ছাড়াই যেন তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল আর নিজেদের মধ্যে চিৎকারচেঁচামেচি জুড়ে দিল। মেজাজ খিচড়ে গেল বুড়ি দাদির। রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ হৈচৈ বাধিয়ে দিলি কেন?
বাচ্চারা উত্তর দিল না। তবে আঙুল দিয়ে রান্না ঘরের মেঝে দেখিয়ে দিল। ফিলোমেনা যখন দেখলেন ওগুলোকে তখন রক্ত জল হয়ে গেল তার, মুখে ফুটে উঠল আতংকের রেখা। একটার পর একটা বেশ অনেকগুলো মুখ গজিয়ে উঠছে গোলাপি মেঝেতে।
ছেলে-মেয়েগুলোকে সাহস দেওয়ার জন্য একটা ডাস্টার তুলে মুখগুলো মোছা শুরু করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু তো হলোই না, উল্টো চোখ বড় বড় করে এভাবে হাসির ভঙ্গি করল মুখগুলো, যে সবচেয়ে সাহসী মানুষেরও আত্মা শুকিয়ে যাবে।
দেরি না করে বাড়িটা খালি করে সরে পড়লেন ওর বাসিন্দারা। আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। প্রশাসনের কর্মকর্তা আর পুলিশ পিলে চমকে দেওয়া এই ঘটনার তদন্ত শুরু করলেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও এই মুখগুলোর আবির্ভাবের কোনো বাস্তবসম্মত কারণ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলেন। অতএব বাড়ির মালিককে নতুন একটা মেঝে বানানোর পরামর্শ দিলেন তাঁরা। পুরো মেঝে খুঁড়ে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তারপর নতুন মেঝে বনাননা হলো। এবার রেহাই মিলবে অদ্ভুতুড়ে এই মুখেদের কবল থেকে, এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন সবাই। কয়েকটা দিন শান্তিতেই কাটল। তারপর একের পর এক নতুন সব চেহারা ভেসে উঠতে লাগল নতুন মেঝেতে।
আবার ডাক পড়ল তদন্ত কর্মকর্তাদের। এবার গোটা এলাকাটা গভীর করে খুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন তাঁরা। এবার কিন্তু বেশ কিছু সমাধি পাওয়া গেল এখানকার মাটির নীচে। ধরে নেওয়া হলো মধ্যযুগে একটা গোরস্থান ছিল জায়গাটা। আবারও নতুন একটা মেঝে বানানো হলো। পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে নতুন নতুন মুখ আবির্ভূত হতে লাগল মেঝেতে। এখন এমনকী মুখগুলো পুরুষ না মহিলার এটাও বোঝা যাচ্ছে।
বাড়িটাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে অদ্ভুত এই ঘটনার রহস্য উদ্ধারে জোর তদন্ত শুরু হলো। এমনকি মৃদুতর শব্দও রেকর্ড করার জন্য অত্যাধুনিক আর স্পর্শকাতর সব যন্ত্রপাতি পাতা হলো। ফলাফল পেতেও দেরি হলো না। গোটা এলাকটাতে অবাক করা কণ্ঠ, গোঙানি আর অপরিচিত ভাষায় কথা রেকর্ড করা হলো।
এবার এসব অতৃপ্ত আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করলেন গ্রামবাসীরা। আর এরপরই বন্ধ হয়ে গেল ভৌতিক সব মুখ দেখা দেওয়া। অনেক বিশেষজ্ঞই পরে বেলমিজ গ্রামের এই আশ্চর্য ঘটনা তদন্ত করে দেখেছেন। তাঁরা সবাই একমত হয়েছেন এর পিছনে কোনো ধরনের ছলচাতুরি বা মানুষের হাত ছিল না।
৪. রক্তচিহ্ন
রক্তচিহ্ন
এবারের অভিজ্ঞতাটি চার্চ অভ ইংল্যাণ্ডের এক যাজকের। তিনি তখন ইতালির ফ্লোরেন্সে ব্রিটিশ দূতাবাসের গির্জার যাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর মুখ থেকেই শুনব কাহিনিটি।
১৮৫৬ সালে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমুদ্রতীরবর্তী একটা জায়গায় ছুটি কাটাচ্ছি। এসময়ই ব্যক্তিগত একটা কাজে তিন-চারদিনের জন্য তাদের ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আগস্টের আট তারিখ সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিত এক অতিথি হিসাবে একটি বাড়িতে হাজির হলাম। এই বাড়ির যিনি কর্তা তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে আমার। আর ওই মুহূর্তে কোনো একটি কারণে আমার বোনও ওই বাড়িতেই থাকছে।
পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেছে। তারপর আবার ভ্রমণে ক্লান্ত। খাওয়া-দাওয়া শেষে দেরি না করে বিছানায় চলে গেলাম। অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। তিন-চার ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসছে না দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। কারণ অপরিচিত জায়গায় কখনওই ভাল ঘুম হয় না আমার। আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দিনের পরিকল্পনা সাজাতে লাগলাম মনে মনে। এভাবে কিছুটা সময় পার হলো। তারপরই হঠাৎ খেয়াল করলাম কামরায় একটা আলো দেখা যাচ্ছে। ঘুরেই একটা নারীর অবয়ব দেখতে পেলাম। আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম এসময়ই। যে আলোয় নারীটিকে দেখেছি সেটা যেন কোনো উৎস ছাড়া আপনা আপনি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে কাঠামোটার দিকে তাকালাম। কিন্তু অবয়বটা পরিষ্কার হলো না। একটু দূরত্ব পেরিয়ে যেভাবে এসেছে সেভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হলো।
শুরুতে আমার মনে হলো এর মধ্যে কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। বিছানা থেকে নেমে একটা বাতি জ্বাললাম। দেখলাম শোবার কামরাটার দরজা আটকানোই আছে। সাবধানে দেয়ালগুলো দেখতে লাগলাম, যদি গোপন কোনো দরজা থাকে। কিন্তু এ ধরনের কিছু খুঁজে পেলাম না। পর্দা সরিয়ে, জানালার পাল্লা খুলে দেখলাম। কিন্তু বাইরেটা নিশ্ৰুপ আর অন্ধকার। চাঁদও নেই আকাশে। বিছানায় ফিরে বিষয়টি নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। কী দেখলাম? আর এটা কেনই বা আমার সামনে হাজির হলো?