কর্নেলের দূরবীন বিধ্বস্ত একটা জাহাজ আবিষ্কার করল। আস্তে আস্তে বরফ ওটার দখল নিয়ে নিচ্ছে। কাছে পৌঁছতেই নিশ্চিত হওয়া গেল জাহাজটা যাত্রী নিয়ে কানাডার কুইবেক থেকে লিভারপুলের দিকে যাচ্ছিল। এখন ওটা পুরোপুরি বরফে আটকা পড়ে আছে। কয়েকটা সপ্তাহ খুব খারাপ অবস্থাতেই কেটেছে ওটার। এমনকি খাবার শেষ হয়ে পানিও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। জাহাজের নাবিক আর যাত্রীরা বাঁচার সব আশা ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে এমন সময়ই এল সাহায্যটা।
বিধ্বস্ত জাহাজটা উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। নৌকাতে করে সেখান থেকে লোকদের নিয়ে আসা হতে লাগল এই জাহাজে। তৃতীয় নৌকাটা সবে এসে ভিড়েছে জাহাজের কিনারে। একজন একজন করে লোক উঠছে জাহাজে। এমন সময় একটা লোকের চেহারার দিকে দৃষ্টি চলে গেল ফার্স্ট মেটের। ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি। এটাই সেই মুখ। তিন-চার ঘণ্টা আগেই যেটা দেখেছেন, ক্যাপ্টেনের ডেস্কে বসে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এক মুহূর্ত দেরি না ক্যাপ্টেনকে বিষয়টি জানালেন।
বিধ্বস্ত জাহাজের যাত্রীরা একটু সুস্থির হওয়ার পর রহস্যময় সেই আগন্তুকের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। তারপর বললেন, আশা করি, স্যর, আমার আচরণে ব্রিত হবেন না আপনি। কিন্তু দয়া করে যদি এই স্লেটটাতে কয়েকটি শব্দ লিখতেন তবে দারুণ উপকৃত হতাম। তারপর স্লেটের যেদিকটায় রহস্যময় লেখাটা নেই সেদিকটা ওপরে দিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
আপনি যেটা বলবেন সেটাই লিখতে রাজি আছি আমি। বললেন আগন্তুক, কিন্তু কী লিখতে হবে?
লিখুন, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।
সন্দেহ নেই এমন অনুরোধে যাত্রীটি বেশ অবাক হয়েছেন। তবে কিছু না বলে হেসে শব্দগুলো লিখলেন।
এবার ক্যাপ্টেন স্লেটটা টেনে নিয়ে ভালমত পরীক্ষা করলেন লেখাটা। তারপর একপাশে সরে গিয়ে যাত্রীটির থেকে আড়াল করে ওটা উল্টে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
তাহলে, ওটা আপনার হাতের লেখা? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন।
মনে হয় না এর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ আপনিই আমাকে লিখতে দেখেছেন। উত্তর দিলেন যাত্রীটি।
আর এটা। এবার স্লেটটা উল্টে দেখালেন ক্যাপ্টেন।
লোকটা প্রথমে একটা লেখা দেখলেন, তারপর আরেকটা। সন্দেহ নেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। একসময় কথা বলে উঠলেন, এর মানে কী? আমি কেবল একটা লিখেছি। বাকি লেখাটা তবে কার?
এটা আমারও প্রশ্ন। আমার মেট আজ দুপুরে আপনাকে এটা লিখতে দেখেছে, এই ডেস্কে বসে।
বিধ্বস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন আর যাত্রী অবাক দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। তারপরই প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেন, এই স্লেটে লিখছেন, এমন কোনো স্বপ্ন কি আপনি দেখেছেন?
না, স্যর, তেমন কিছু মনে পড়ছে না।
আপনি স্বপ্নের কথা বলছেন। আজ দুপুরের দিকে এই ভদ্রলোক কী করছিলেন? জানতে চাইলেন উদ্ধারকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেন, গোটা বিষয়টাই খুব রহস্যময় আর অদ্ভুত বলতে শুরু করলেন বিধ্বস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন, আরেকটু ধাতস্থ হওয়ার পর ওটা আমি আপনাকে খুলে বলতে চেয়েছিলাম। এই যাত্রীটির শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে গভীর ঘুমে ডুবে যান তিনি, ওটা দুপুরের কিছু সময় আগের কথা। এক ঘণ্টা কিংবা তার কিছুটা পরে ঘুম থেকে উঠে আমাকে বললেন, ক্যাপ্টেন আজই আমরা উদ্ধার পাব। তিনি কীভাবে এটা বলছেন জানতে চাইলে জবাব দিলেন, স্বপ্নে দেখেছেন একটা বারকুতে আছেন। আর ওটা আমাদের উদ্ধারে আসছে। তারপর জাহাজটা এবং ওটার পাল-মাস্তুল এসবের বর্ণনা দিয়ে গেলেন। আর কী আশ্চর্য, যখন আপনার জাহাজটা দেখা গেল, আমরা আবিষ্কার করলাম তাঁর বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সব। শুরুতে তাঁর কথার ওপর খুব একটা আস্থা ছিল না আমাদের। তারপরও আশা করেছি এর মধ্যে কিছু একটা আছে। জানেনই তো ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। তবে সত্যি যখন তার কথা হুবহু ফলে গেল তখন আর সন্দেহ রইল না অদৃশ্য কোনো শক্তির খেয়ালেই এটা হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই। বললেন বারকুর ক্যাপ্টেন, স্লেটের এই লেখাই আপনাদের জীবন বাঁচিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে চলছিল জাহাজ। এই লেখা দেখেই জাহাজের গতি পথ বদলে উত্তরপশ্চিমে চলার নির্দেশ দিই আমি। আর সামনে কী আছে দেখার জন্য একজন প্রহরী দাঁড় করিয়ে দিই। তারপর যাত্রীটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু স্লেটে কিছু লেখার স্বপ্ন দেখেননি আপনি?
না, স্যর। কীভাবে এটা হলো সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারব না আমি। আমার কেবল মনে হয়েছে স্বপ্নে যে জাহাজটা দেখেছি সেটা আমাদের উদ্ধর করতে আসবে। কিন্তু এটা কেন মনে হয়েছে এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আর একটা আশ্চর্য বিষয় হলো, এখানের সব কিছু কেমন পরিচিত ঠেকছে আমার। কিন্তু এতে সন্দেহ নেই আগে কখনও আপনার জাহাজে উঠিনি আমি। পুরো বিষয়টাই বিস্ময়কর। কিন্তু আপনার মেট কী দেখেছে?
মি. ব্রুস এবার তার দেখা পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন।
৩. রাতের অতিথি
রাতের অতিথি
এবারের অভিজ্ঞতাটি লিমেরিকের আর্চডিকন রেভারেণ্ড জে. এ. হেইডেনের। ১৮৭৯ সালের দিকে অ্যালারির একটা চমৎকার গ্রামে বাস করতেন এক ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর। আমার বাসার থেকে তাঁরা যেখানে থাকতেন তার দূরত্ব আট-ন মাইল। ভদ্রলোকের সঙ্গে দারুণ একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। যখনকার কথা বলছি তখন তার স্ত্রী তৃতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার অপেক্ষা করছেন। ছোটখাট, হ্যাংলা-পাতলা একজন ভদ্রমহিলা তিনি। আসন্ন ঘটনাটা নিয়ে মানসিকভাবেও খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার বাড়িতে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন। এমনকী এর প্রতিটি কামরা, অন্ধিসন্ধিও তাঁদের খুব ভাল চেনা।