এখন যে কাহিনিটি বলব এটা একটা সময় তুমুল সাড়া ফেলেছিল। বিখ্যাত এই বর্ণনাটা পাওয়া গেছে মি. রবার্ট ডেল ওয়েনের কাছ থেকে। এবার তাহলে মূল কাহিনিতে চলে আসা যাক।
কোবার্ট ব্রুস এক স্কটিশ পরিবারের সন্তান। আঠারো শতকের শেষভাগে ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণে টরবেতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ছোটকাল থেকেই সাগরের প্রতি টান তাঁকে জাহাজের চাকরিতে যোগ দিতে উৎসাহ জোগায়। ১৮২৮ সালে, ত্রিশ বছর বয়সে একটা বারকু্যর ( তিনটার বেশি মাস্তুল আছে এমন জাহাজ) ফাস্ট মেট হন তিনি। মূলত লিভারপুল আর নিউ ব্রান্সউইকের সেন্ট জোনসের মধ্যে যাতায়াত করে জাহাজটা।
এক অভিযানে পশ্চিমে মোটামুটি, পাঁচ-ছ সপ্তাহ চলার পর নিউ ফাউণ্ডল্যাণ্ডের পুব তীরের কাছাকাছি চলে এলেন তাঁরা। দুপুরের দিকে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলেন ক্যাপ্টেন আর মেট। তারপর দিনের কাজের হিসাব-নিকাশ করার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন দুজনে। ক্যাপ্টেনের ছোট্ট কেবিন জাহাজের স্টার্নের কাছেই। এদিকে মেটের স্টেট রুমটা খুব দূরে নয় কেবিন থেকে। স্টেটরুমের টেবিলটা দরজা লাগোয়া। ওখানে বসে কেউ কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে কেবিনের ভিতরটা দেখতে পাবে।
এদিকে মেট তার রুমে বসে হিসাব মিলাতে গিয়ে মোটামুটি গলদঘর্ম অবস্থায় পড়ে গেছেন। জাহাজের অবস্থানের যে ফলাফল পাচ্ছেন তা মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না তাকে। কাজেই এটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে ক্যাপ্টেনের দিকে নজর নেই তাঁর। যখন হিসাব শেষ করলেন, না ঘুরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, বার বার ল্যাটিচিউড আর ল্যাঙ্গিচিউড নিচ্ছি। এটা কি ঠিক আছে? আপনার হিসাব কী বলে, স্যর?
কিন্তু অপর তরফের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার একই প্রশ্ন করে ঘুরে তাকালেন। যা ভেবেছেন, ক্যাপ্টেন তার স্লেট নিয়ে ব্যস্ত। কী যেন লিখছেন। তবে এবারও কোনো উত্তর মিলল না। উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের দরজার দিকে এগুলেন মেট ব্রুস। এবার যাকে ক্যাপ্টেন ভেবেছেন সেই ভদ্রলোেক মাথা তুললেন। অবাক হয়ে মেট আবিষ্কার করলেন একেবারেই অচেনা একজন লোকের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
ব্রুসকে মোটেই ভীতু বলা চলে না। কিন্তু যখন দেখলেন ক্যাপ্টেনের জায়গায় বসে কস্মিনকালেও দেখেননি এমন একজন মানুষ সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর ওখানে থাকার সাহস করলেন না। আগন্তুককে কোনো ধরনের প্রশ্ন না করেই ডেকের দিকে ছুটলেন। তাঁর মনে হলো সবার আগে এটা ক্যাপ্টেনের নজরে আনা উচিত।
তা, মি. ব্রুস, কী সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছ তুমি? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন।
সমস্যা, স্যর? আপনার ডেস্কে কে? আমার জানা মতে ওখানে কারও থাকার কথা নয়।
কিন্তু আছে। শুধু তাই না একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ। উত্তেজনায় গলা রীতিমত কাঁপছে ব্রুসের।
একজন আগন্তুক! আমার মনে হয় তুমি স্বপ্ন দেখছ। সন্দেহ নেই স্টুয়ার্ড কিংবা সেকেণ্ড মেটকে দেখেছ সেখানে। আর আমার নির্দেশ ছাড়া কারই বা সেখানে যাওয়ার সাহস হবে।
কিন্তু, স্যর, লোকটা দরজার দিকে ফিরে আপনার চেয়ারে বসে আছে। আপনার স্লেটে কী যেন লিখছে। তারপর সরাসরি আমার দিকে তাকাল। আর তাঁকে জীবনে কখনও দেখিনি আমি।
তুমি পাগল হয়ে গেছ, মি. ব্রুস। আমরা ডাঙা ছেড়েছি প্রায় ছসপ্তাহ। এখন জাহাজে একজন অপরিচিত লোক কীভাবে দেখতে পাও?
তারপর আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন ক্যাপ্টেন। মেট তাকে অনুসরণ করলেন। কিন্তু কেবিনে কেউ নেই। স্টেট রুমেও ঢুকলেন তাঁরা। কিন্তু এখানেও কারও অস্তিত্ব পাওয়া গেল না।
তাহলে, মি ব্রুস, আমি বললাম না তুমি স্বপ্ন দেখেছ? কিন্তু, স্যর, তাকে স্লেটে কিছু লিখতেও দেখেছি আমি!
স্লেটে লিখেছে? তাহলে অবশ্যই ওই লেখা এখানে থাকা উচিত। এই বলে ক্যাপ্টেন ওটা হাতে নিলেন। তারপরই বিস্মিত হয়ে বললেন, হায় খোদা! এখানে আসলেই কিছু লেখা আছে। এটা কি তোমার হাতের লেখা, মি. ব্রুস?
স্লেটটা হাতে নিলেন মেট। এটার লেখা বুঝতে একটুও সমস্যা হলো না তার। এখানে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।
তাঁর ডেস্কে বসে আছেন ক্যাপ্টেন। স্লেটটা সামনে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। তারপর স্লেটটাকে উল্টে দিয়ে ব্রুসের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, এখানে লেখো, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।
মেট লিখলেন। এবার দুটো হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন সেকেণ্ড মেটকে ডেকে আনতে বললেন। তিনি আসলে ক্যাপ্টেনের অনুরোধে ওই একই কথা লিখলেন স্লেটে। তারপর লিখলেন স্টুয়ার্ড। একে একে জাহাজের প্রত্যেক কর্মকর্তা আর নাবিকই কথাগুলো লিখলেন। কিন্তু একজনের হাতের লেখাও রহস্যময় সেই লেখার সঙ্গে মিলল না।
নাবিকরা সবাই চলে গেলে আবারও এক মনে চিন্তা করতে লাগলেন ক্যাপ্টেন। একসময় কথা বলে উঠলেন আনমনে, তবে কি কেউ জাহাজে লুকিয়ে আছে? দেরি না করে গোটা জাহাজ তল্লাশির নির্দেশ দিলেন তিনি।
জাহাজের প্রতিটি কোনা-কানাচ, অন্ধিসন্ধি খোঁজা হলো। কিন্তু লুকিয়ে উঠেছে এমন কারো খোঁজ মিলল না।
তারপরই জাহাজের গতিপথ বদলাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ক্যাপ্টেন। যাই থাকে কপালে, স্লেটের নির্দেশিত পথেই জাহাজটা নিয়ে যাওয়া স্থির করেছেন তিনি। একজন লোককে সামনে কিছু আছে নাকি তা নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হলো। একটু পরেই সে একটা আইস বার্গের খবর নিয়ে এল। তার একটু পরেই প্রহরী জানাল একটা জাহাজও নজরে এসেছে তার।