সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব ঘটনা কি. আপনার বিয়ের আগের? না পরের?’
‘বিয়ের আগের। গ্রামে আমার সম্পর্কে বিভিন্ন রটনা রটে যায়। আমার উপর খারাপ জিন ভর করেছে, তাই আমার চেহারা পুরুষালী হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টির সময় আমার মধ্যে জিনের অস্তিত্বটা আরও প্রকট রূপে জেগে ওঠে বলে আমি অচেনা পুরুষ কণ্ঠে কথা বলি। আরও কত কী! আমার বাবা-মা চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। জিনে আছর হওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে? বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় বাড়ি-ঘর-সহায়-সম্পত্তির লোভে একটা ছেলে জুটে যায়। ওই ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দশ দিনের মাথায় আমার শাশুড়ি ধরে ফেলে আমি অন্তঃসত্ত্বা। যেন কেয়ামত নেমে আসে! বিয়ের দশ দিনের মধ্যে কারও অন্তঃসত্ত্বা হবার কথা নয়। হলেও তা কারও বোঝার কথা নয়। আমাকে নষ্টা-ভ্রষ্টা বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
‘গর্ভবতী হওয়ার সাত মাসের মাথায় ঈশিতার জন্ম হয়। বাবা-মা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ঈশিতাকে নিয়ে তাদের সাথেই ছিলাম। তাদের মৃত্যুর পর গ্রামের জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে আসি 1 ঈশিতার বাবা আর কোনও দিনও খোঁজ নেয়নি। সে ঈশিতাকে নিজের সন্তান বলেই স্বীকার করত না।’
সুলতানা বেগম কিছুটা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘বিয়ের সাত মাসের মাথায় যে সন্তানের জন্ম হয়, সে সন্তানকে কোনও বাবারই নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকার করার কথা নয়।
ইয়াসমিন বেগম ফোঁত-ফোঁত করে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, বেয়ান, আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ ঈশিতার বাবাই এসেছিল!’
সুলতানা বেগম আর কিছুই বললেন না। অপলক চোখে ইয়াসমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই চোখে খানিকটা · বিস্ময়, খানিকটা অবিশ্বাস আর খানিকটা সহমর্মিতার সম্মিলন।
.
রাত সোয়া এগারোটা।
বাইরে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি পাগলের মত আচরণ করছেন। পুরুষালী গলায় একেকবার আবোল-তাবোল চিৎকার দিয়ে উঠছেন। তাঁর সেই পুরুষালী গলার স্বর শুনে সুলতানা বেগম চমকে-চমকে উঠছেন। কারণ, ওই পুরুষালী গলার স্বরটা তাঁর খুবই পরিচিত। তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেনের গলার স্বরও এমন ছিল। যেন ইয়াসমিন বেগম নন, তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেন চিৎকার করছেন।
পাঁচ
বৈশাখ মাস পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। দু’এক দিন বাদে- বাদেই ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা দেখা দিচ্ছে।
মাথা যন্ত্রণার মুহূর্তে ইয়াসমিন বেগমের কিছু আচরণ সুলতানা বেগমকে চরম ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না।
এর মধ্যে একদিন ইয়াসমিন বেগমের মাথা ব্যথা শুরু হবার পর সুলতানা বেগম কাছে গেলে পুরুষালী গলায় বলে ওঠেন, ‘সুলতানা, তুমি এতদিন পর আমাকে দেখতে এসেছ?’
সুলতানা বেগম স্থবিরের মত থমকে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। যেন কথাটা বাইশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তাঁর স্বামী আমজাদ হোসেন বলেছেন।
ইয়াসমিন বেগম আবার পুরুষালী গলায় বলেন, ‘সুলতানা, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার আমজাদ, ‘আম’। ভুলে গেছ, তুমি দুষ্টুমি করে আমাকে ‘আম’ বলে ডাকতে। আর আমি তোমাকে ‘সু- লতা’ বলে। সে কথা তোমার মনে নেই?’
সুলতানা বেগম কেঁপে ওঠেন। তাঁর হাত-পায়ের তালু, কপাল ঘামতে শুরু করে। সত্যিই তিনি তাঁর স্বামীকে দুষ্টুমি করে মাঝে-মাঝে ‘আম’ বলে ডাকতেন। আর তাঁর স্বামী তাকে ‘সু-লতা’ বলে ডাকতেন। এ ব্যাপারটা তো কোনওভাবেই ইয়াসমিন বেগমের জানার কথা নয়! কারওই জানার কথা নয়।
শুধু তা-ই নয়, মাথা ব্যথার সময় ইয়াসমিন বেগম নিজেকে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করেন। এবং আমজাদ হোসেনের সব কথাই গড়-গড় করে বলতে পারেন। খুব গোপন কথাও। মানে যা কিছু শুধু আমজাদ হোসেনের জানার কথা। যেন সেই মুহূর্তে ইয়াসমিন বেগমের উপর আমজাদ হোসেনের আত্মা ভর করে।
সুলতানা বেগম কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেন না। ইয়াসমিন বেগম কেন তাঁর স্বামীর মত করে কথা বলবেন? এর পেছনে কী রহস্য?
সুলতানা বেগম ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এর আগেও কি মাথা যন্ত্রণা শুরু হলে তার মা এই একই গলার স্বরে কথা বলতেন? নিজেকে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করতেন?
ঈশিতা বলেছে, হ্যাঁ। এই গলার স্বরেই কথা বলতেন। নিজেকে অন্য একজন বলে দাবি করতেন। তবে আমজাদ হোসেন বলে দাবি করতেন কি না তা কখনও সেভাবে খেয়াল করে দেখেনি। তবে এটা তার মনে আছে, মাথা খারাপের মুহূর্তে সে তার মায়ের মুখে বহুবার সুলতানা, সু- লতা নামটা শুনেছে।
ইয়াসমিন বেগম নিজেকে আমজাদ হোসেন দাবি করার এক মুহূর্তে সুলতানা বেগম তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, সত্যিই যদি আপনি আমজাদ হোসেন হন, তা হলে বলুন তো বাইশ বছর আগে আপনি কোথায় হারিয়ে গেছেন? কীভাবে হারিয়ে গেছেন? সেদিন কত তারিখ ছিল?’
ইয়াসমিন বেগম আমজাদ হোসেনের মত গলার স্বরে জানান, ‘সেদিন ছিল ১১ই বৈশাখ। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন ছিল। ভোরবেলায় বিয়ের শাড়ি পরে সেজে- গুজে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলে তুমি। খিচুড়ি রান্না করেছিলে। আমি পাঞ্জাবি পরে অফিসে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সুমনকে নিয়ে, ওকে স্কুলে পৌঁছে দেবার জন্য। তোমার হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে গিয়েছিলাম ভাল-মন্দ বাজার করে রান্না করার জন্য। তুমি আমাকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসার অনুরোধ করেছিলে।’