পোঁটলাটা খুলে একটা মাত্র ধান দু’আঙুলে তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল মৃণাল বাবু। আকারে বেশ ছোট এবং গোল ধরনের ধান, গায়ে ঝকঝকে সোনালি আর গাঢ় খয়েরি ডোরাকাটা। ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। এটাই ডুমাহি ধান। আপনি খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নিন। রাত বারোটায় ফের দেখা হবে। মন্দাকিনী, ওকে ওর ঘর দেখিয়ে দাও।’
‘স্যর, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’
‘কী প্রশ্ন, অমল বাবু?’
এই ধান তো আগেও জোগাড় করা যেত। আমাকে দিয়ে এত তাড়াহুড়ো করে এটা নিয়ে আসার কারণ কী?’
‘যে কাজটা আমি করতে চাই, সেটার পুরো প্রক্রিয়াতে কিছুটা হলেও আপনার অবদান থাকতে হবে। আপনি যে স্বেচ্ছায় আপনার আয়ু দিতে চাচ্ছেন, সেইটে হতে হবে প্রমাণিত সত্য। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন, এখন যান। ঘুমিয়ে ফ্রেশ হন। সারারাত জাগতে হবে।’
বারো
রাত এগারোটার সময় অমলকে ঘুম থেকে ওঠাল মন্দাকিনী। তাকে বাথরুমে নিয়ে মাথার সব চুল কেটে ন্যাড়া করে দিল। ওয়ান টাইম রেজর চালিয়ে চেঁছে দিল বগলের নিচ। তারপর অমলের হাতে ছোট কেঁচি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেখানে যত অনাকাঙ্ক্ষিত কেশ আছে, সব সাফ করে সাবান মেখে স্নান সেরে ফেলেন। বাথরুমে সাদা থান কাপড় রাখা আছে। স্নানের পর ওটা পরবেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। হলঘরে মৃণাল বাবু অপেক্ষা করছেন। আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’
মনে-মনে বিরক্ত হলো অমল। বলল, ‘লক্ষ করেছি, আসার পর থেকেই আপনি আশপাশে ঘুরঘুর করছেন। আমাকে একা থাকতেই দেয়া হচ্ছে না। বিষয় কী জানতে পারি?’
‘অবশ্যই পারেন। আজকের রাতটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাতে আপনাকে নিয়ে সাধনায় বসবেন মৃণাল বাবু। বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মেনে তারপর সাধনায় বসতে হয়। নিজের অজান্তে আপনি উল্টো-পাল্টা কিছু করে বসলে সাধনা পণ্ড হতে পারে। শেষ মুহূর্তে এসে এই ঝুঁকি নেয়া যাবে না। বোঝা গেছে?’
বাথরুম থেকে বেরনোর পর অমলকে হলঘরে মৃণাল বাবুর কাছে নিয়ে গেল মন্দাকিনী। অমল লক্ষ করল, আমূল বদলে গেছে হলঘরটা। বিরাট ফাঁকা ঘরটাতে ছয়টা মাটির পিদিমের হালকা আলোয় শুধু আয়তাকার নিচু মতন একটা বেদী চোখে পড়ল। বেদীর ওপর আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ছিন্ন-মস্তার কুচকুচে কালো কষ্টি পাথরের অপার্থিব মূর্তি। অনেক উঁচুতে কাঁচের পাল্লা বসানো ছাতের বেশ কিছু পাল্লা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অমলের চোখে পড়ল কালো আকাশের পটভূমিতে নক্ষত্রের মিটিমিটি। মূর্তির সামনে সাদা-কালো মার্বেল মেঝের ওপর বিরাট সবুজ রঙের বারোটা পাপড়িঅলা পদ্মের মাঝখানে লাল ত্রিভুজের ভেতর সাদা হেক্সাগ্রাম আঁকা। পদ্মের বারোটা পাপড়ির ছয়টির মাথার কোণগুলোর ভেতর পাকা কলা, নারকোল, আখের টুকরো, জবা, পদ্ম ও ধুতুরা ফুল রাখা। বাকি ছয়টিতে সোনা, রূপা, লোহা, তামা, দস্তা এবং পারদ। ছয়টি দুষ্প্রাপ্য ও সহজলভ্য ভিন্ন-ভিন্ন ধাতু। ত্রিভুজের তিন কোণ ভর্তি খই। বোঝাই যাচ্ছে, ওগুলো ডুমাহি ধানের। হেক্সাগ্রামের ছয় কোণের মাথার কোণটা ছিন্ন-মস্তার মূর্তির দিকে তীরের মত সোজা করে আঁকা। কোণটা খালি। উল্টোদিকের কোণটারও একই অবস্থা। ডানে-বাঁয়ে দুটো-দুটো চারটে কোণে চারটে কাঁচের খুরি। খুরিগুলোর তিনটিতে মাটি, জল, জ্বলন্ত অঙ্গার; চার নম্বর খুরির মুখ কাঁচের ঢাকনা দিয়ে আটকানো। ভেতরে কিছু নেই। সবুজ রঙের পদ্মফুলটাকে ঘিরে সাদা কালিতে লেখা: ‘পন্তিফিক্স ইন্তেরিস নুমেআতেম আউদিঅরাশিওনেম মিয়ামেত সেকুন্দুম ইম্পেরিয়ুম।’
এতকিছু দেখতে অমলের সময় লাগল মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। তার দিকে এগিয়ে এল মৃণাল বাবু। তাঁর পরনেও সাদা থান, মাথাতে কোনও চুল নেই। সম্ভবত অসুখই দফা শেষ করেছে ওগুলোর।
‘অমল বাবু, আপনি রেডি তো?’
‘আজ্ঞে, আমি রেডি। কী করতে হবে বলেন।’
‘বলব, তবে তার আগে কিছু কথা আপনার জানা দরকার। আয়ু বাড়ানোর জন্য ছিন্ন-মস্তাকে আহ্বান করব আমি। ইউরোপ-আমেরিকা হলে অন্য দেবীকে ডাকতে হত। যে দেশে যে দেবীর পুজো হয়, তাকে ডাকাই ভাল। তা ছাড়া, দেব- দেবীরা পূজারীর ডাকে সাধারণত মাত্র একবারই সাড়া দেন। সিরাস এবং আমি পশ্চিমা দেশের পরিচিত প্রায় সব দেবীকেই নৈবেদ্য দিয়েছি। এখন বাকি আছে শুধু ছিন্ন-মস্তা আর বগ্লামুখীর মত দেবীরাই।
‘ছিন্ন-মস্তার সাধনার জন্যে দরকার হয় সঠিক তিথির। এই ব্রহ্মাণ্ডকে ঘিরে আছে অসংখ্য বলয় বা স্ফেয়ার। এমনই একটি বলয়ে বেশিরভাগ দেব-দেবীর অবস্থান। মাঝে-মাঝে গ্রহ- নক্ষত্রের অবস্থান এমন হয় যে, ওই বলয়টা পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে। দেব-দেবীরা আগ্রহ নিয়ে তাঁদের ভক্তদের দেখেন। এই সময়টাকেই বলা হয় মাহেন্দ্রক্ষণ। তখন কোনও দেবী কিংবা দেবতাকে ডাকলে তাঁরা ভক্তের ডাকে সাড়া দেন। আজ শুক্রবার কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী। প্রতি দু শ’ বছরে নব্বই ডিগ্রিতে সৌরজগতের সব গ্রহ এক লাইনে আসে। ত্রিশ ডিগ্রিতেও আসে এক লাইনে। তবে সেটা হয় প্রতি তেত্রিশ শত বছরে একবার। খ্রিস্টের জন্মের ৫৮১ বছর আগে একবার হয়েছিল। হেকাটির মন্দির ওই বছরই তৈরি হয়। আমাদের ভাগ্য সাঙ্ঘাতিক ভাল, কারণ প্রতি দু’ শ’ বছরে যে ঘটনাটা ঘটার, সেটি ঘটছে এখনই। প্রতি বছর একুশে ডিসেম্বর পৃথিবী কর্কট নক্ষত্রমণ্ডলীর কাছে চলে আসে। পৃথিবীর ডান দিকে থাকে কর্কট নক্ষত্র, বাঁ দিকে সূর্য আর মকর নক্ষত্র এবং উপরে কন্যা নক্ষত্রমণ্ডলী। আজ রাতে পৃথিবী সহ সৌরজগতের সব গ্রহ মিলে ট্রায়াঙ্গেল তৈরি হবে। আগেই বলেছি, ব্ল্যাক আর্ট প্র্যাকটিস শুরু হয়েছিল প্রাচীন ব্যাবিলনে, সুমেরীয় সভ্যতার সময়। ইতিহাস বলে, আধুনিক অ্যাস্ট্রোনমির জন্মও ওই সময়েই। আসলে ব্ল্যাক আর্ট প্র্যাকটিশনাররাই অ্যাস্ট্রোনমির জনক। নক্ষত্র-তিথির জ্ঞান ব্ল্যাক আর্টের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই কারণেই যুগে যুগে অতি শিক্ষিত আর জ্ঞানী লোকেরাই এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে পেরেছে। জাদুকর মার্লিন, গ্যালিলিও, গিওর্দানো ব্রুনো, আইজ্যাক নিউটন, ইয়োহ্যানেস কেপলার এঁদের কথা ভেবে দেখেন। এঁরা সবাই জগদ্বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনমার, অথচ তাদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাক আর্ট চর্চার অভিযোগ আছে! সে যা হোক, এত কথা বলছি শুধু আজ রাতের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে। হেক্সাগ্রামের চার কোণে ব্রহ্মাণ্ডের চারটি মৌলিক উপাদান রাখা হয়েছে: মাটি, আগুন, জল আর হাওয়া। উপরের কোণটাতে বসব আমি। সব থেকে নিচের কোণটাতে বসবেন আপনি। ছিন্ন-মস্তা একই সঙ্গে উর্বরতা এবং মৃত্যুর দেবী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিরল নক্ষত্র-তিথি মেনে সঠিক উপাচার সাজিয়ে যেভাবে সাধনায় বসতে যাচ্ছি, তাতে করে দেবী আমার ডাকে সাড়া দেবেন। তবে দেবী এলেও নিজ রূপে আসবেন না। উনি নেমে আসবেন মহা ডামরী-র রূপ ধরে। অতি ভয়ঙ্কর রূপ এই মহা ডামরীর। তাঁকে নেমে আসতে দেখে আতঙ্কে মূর্ছা যায়নি এমন সাধক নেই বললেই চলে। অনেকে তাঁর রূপ দেখে ভয়ে মারাও গেছে। আপনাকে একটা মন্ত্র মুখস্থ করাব। আপনাকে যেখানটায় বসাব, সেখানে বসে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ রেখে ওই মন্ত্রটা পড়বেন। যা-ই ঘটুক না কেন, চোখ খুলবেন না কোনও মতেই। এত কিছু বলছি, কারণ মহা ডামরী চাইবে আপনি তাঁকে দেখেন এবং সাধনা পণ্ড হোক। মন্ত্রটা শিখে নেন: ‘দিসেম আনোস দিয়াদমিনিমেই’। আমার সব মন্ত্রই ল্যাটিন, সিরাসের কাছ থেকে শেখা। অন্য মন্ত্র জানা নেই। সিরাস বলত, মানুষের সব ভাষা দেব-দেবীদের জানা। প্রয়োজন শুধু সঠিক মন্ত্র ও উচ্চারণ। মন্দাকিনী, তুমি এখন যাও। ভোরে দেখা হবে। যাওয়ার আগে ছাগীটা এনে দাও।
তেরো
রাত বারোটা তিন মিনিটে ছিন্ন-মস্তার মূর্তির সামনে একটা পোয়াতি ছাগী বলি দিল মৃণাল বাবু। মৃত ছাগীর পেট চিরে বের করল দুটো মরা বাচ্চা। বাচ্চাদুটোর বুক ফেড়ে হার্ট বের করে ওগুলো থেকে দু’টুকরো মাংস কেটে এক টুকরো নিজে চিবিয়ে খেল, অন্য টুকরোটা খেতে দিল অমলকে। কাজ দেখে গা গুলিয়ে উঠল অমলের। কিন্তু না খেয়ে উপায় নেই। সে দেখল ভাঁটার মত ধক্কক্ করে জ্বলছে মৃণাল বাবুর চোখের তারা। এরপর মৃণাল বাবু দেবদুয়ার থেকে সংগ্রহ করা গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিল অমলের টাকের ওপর। জলটা ভীষণ ঠাণ্ডা। অমলের মনে হলো তার মাথা চিরে হার্টে চলে গেছে ওই জল। মনে হলো বহুদূর থেকে কে যেন বলছে, এ এক ধরনের মার্কিং, দেবী যেন আপনাকে চিনতে পারেন। গলা শুনে তার মনে হলো, মৃণাল বাবু না, কথা বলছে মহাশ্মশান থেকে উঠে আসা কোনও প্রেত। এরপর মৃণাল বাবু বসল হেক্সাগ্রামের মাথার কোণটার ভেতর, অমলকে বসাল নিচের কোণটাতে। কিছুক্ষণ পরেই ঘোর লাগা অবস্থায় অমল শুনতে পেল বিচিত্র ভাষার গুনগুন মন্ত্র উচ্চারণ। প্রথমে একটা কণ্ঠস্বর, তারপর অসংখ্য। যেন মৃণাল বাবুর সঙ্গে মন্ত্র পড়ছে অগুনতি প্রেতাত্মা। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল সেই ধ্বনি। মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে, ভেঙে-চুরে উড়ে যাবে ঘরের দেয়াল, জানালা-দরজা। ঘেমে নেয়ে যেতে লাগল অমল। হঠাৎ করেই কমতে লাগল ঘরের তাপমাত্রা। সেই সঙ্গে বদলে গেল অযুত কণ্ঠের উচ্চারণ করা ধ্বনিও। এবার অমল শুনতে পেল সম্মিলিত বিলাপের সুর। হিম এমন বাড়ল যে অমলের মনে হলো শরীরের প্রতিটি রক্তকণা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের ভেতর চোখের সামনে ভেসে উঠল জীবনের সমস্ত ঘটনা। ঠিক তার পরেই দপ করে নিভে গেল সব কিছু।