হোটেল-বোর্ডিং এখানে নেই। রাতটা কোথায় কাটাবে বুঝতে পারছে না। বাজারটা ছোট হলেও ভাল। ছোটখাট রেস্তোরাঁ, চায়ের স্টল, মনোহারি দোকান, এমন কী ইলেকট্রনিক আইটেম সারাইয়ের দোকানও আছে। সম্ভবত খাসিয়াদের জন্যেই- এসবের আয়োজন। রেস্টুরেন্টে খেয়েদেয়ে রাতে কোথায় থাকা যায় মালিকের কাছে সেই কথা পাড়ল অমল। মসজিদের মোয়াজ্জিনের ঘরে থাকার ব্যবস্থা হলো। সে জাতে হিন্দু হলেও সমস্যা নেই। মেহমান বলে কথা। তবে ট্যাকের ঘাটে আসার উদ্দেশ্য গোপন রেখে জানাল, এমনিই বেড়ানোর জন্যে এসেছে। পরদিন মসজিদের পুকুরে স্নান করে নাস্তা সেরে আবারও রেইনট্রি গাছটার নিচে গিয়ে বসল অমল। এখন খাসিয়া মেয়েরা কখন আসে, সেই অপেক্ষা। এগারোটা বেজে গেল, খাসিয়াদের দেখা নেই। এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। বাজারে ফিরে গিয়ে খাসিয়া মেয়েরা কখন আসবে সেইটে জিজ্ঞেস করা সম্ভব না। উল্টো-পাল্টা ভেবে বসতে পারে। বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল অমল। আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ের ট্রেইল বেয়ে পিলপিল করে নেমে আসছে একদল খাসিয়া মেয়ে। পিঠে খড়ির বোঝা। মেয়েগুলো সোজা এসে থামল রেইনট্রি গাছটার নিচে। লাকড়ির বোঝা নামিয়ে জিরোতে বসল। তাদের ফর্সা ধবধবে গালে লাল রঙের ছোপ, কপালে মেরুন টিপ। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল অমল। মাঝবয়সী তিনজন মহিলার সব খড়ি কিনে ফেলল। দর-দামের ধারই ধারল না। এরপর পাড়ল আসল কথা। সর্দারনী টাইপ একজনের হাতে পাঁচ শ’ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল এক কেজি ডুমাহি ধান এনে দিতে। এবং সেটা আজকের মধ্যেই। মহিলা জানাল আজ আর হবে না। ওখান থেকে তার বাড়ি আধা বেলার রাস্তা। তা ছাড়া, বর্ডার দিনে একবারই পার হওয়া যায়। পরদিন সকালে এনে দেবে।
পর-পর দু’রাত মোয়াজ্জিনের ঘরে থাকা সম্ভব না। মহাযন্ত্রণা হলো দেখছি, মনে-মনে ভাবল অমল। কিন্তু কী আর করা? গাছতলায় শুতে হলেও আরও একটা রাত এখানে তাকে কাটাতে হবে। গাছতলায় শুতে সমস্যা নেই, সমস্যা হলো লোকে সন্দেহ করতে পারে। নানান প্রশ্ন করবে তারা। ফেরারি আসামি ভেবে পুলিশে খবর দেয়াও বিচিত্র না। অমল মহিলাকে জানাল, ধান হাতে পাওয়ার পর আরও পাঁচ শ’ টাকা বকশিশ দেয়া হবে। তবে সকাল সকাল এনে দিতে হবে। কথাবার্তা সেরে বাজারের দিকে হাঁটা ধরল অমল। এমন সময় পেছন থেকে মহিলাদের ডাক শুনে থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। মহিলারা জানতে চাচ্ছে, খড়ির বোঝা কোথায় ডেলিভারি দিতে হবে। ধানের টেনশনে খড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে। অমল জানাল আপাতত খড়িগুলো ওখানেই থাক। পরে উঠিয়ে নেবে। আগের রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে অমল জানাল, তার শরীরটা ভাল না। বিছানায় শুয়ে একটু রেস্ট নিতে চায় সে। আবারও মোয়াজ্জিনের ঘর। রাতে কিছু খেল না অমল। বলল, পেট খারাপ। কোনও মতে রাতটা যাতে পার হয়, ভগবানের কাছে সেই প্রার্থনা। পরদিন সকালে মোয়াজ্জিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে আবার গাছতলা। রাতে হাওয়া হয়ে গেছে খড়ির বোঝাগুলো। খাসিয়া সর্দারনী ধান নিয়ে এলেই হয় এখন।
বেলা চড়ে গেল, খাসিয়া মেয়েরা আসছে-যাচ্ছে, অথচ সর্দারনীর দেখা নেই। সুনামগঞ্জ ফিরতে হলে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রওনা হতে হবে। এরপর অতদূরের রাস্তায় কেউ আর যেতে চাইবে না। অধৈর্য হয়ে পায়চারী শুরু করল অমল। কী সিদ্ধান্ত নেবে ভেবে পাচ্ছে না। খাসিয়া মেয়েদের কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে, সেটাও সম্ভব নয়। কাল যে মেয়েগুলো এসেছিল, আজ তাদের কেউ আসেনি। সর্দারনীর নাম পর্যন্ত জানে না সে। একটাই রাস্তা খোলা আছে, সেটা হলো আজ সুনামগঞ্জ গিয়ে রাতটা কাটিয়ে কাল আবার এখানে ফিরে আসা। কিন্তু ফিরে আসতে গেলেও দিন পার হয়ে যাবে। এর ভেতর সর্দারনী এসে তাকে না পেয়ে ফিরে গেলে আর হয়তো দেখাই হবে না। হলেও সেটা হবে একুশ তারিখের পর। তখন আর কী হবে ওই ধান দিয়ে? গাছতলায় বসে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল অমল। ভোঁ-ভোঁ করছে মাথার ভেতর। মনে হচ্ছে শূন্য হয়ে গেছে করোটি। কতক্ষণ এরকম সমাধিস্থ অবস্থায় কেটে গেছে বলতে পারবে না অমল। তার সংবিৎ ফিরল ‘হেই, বাবু!’ ডাক শুনে। চোখ তুলে দেখল, তার সামনে দাঁড়ানো সর্দারনী, হাতে পুরানো কাপড়ের ছোট একটা পোঁটলা। সর্দারনী জানাল এক কেজি পাওয়া যায়নি, অনেক খুঁজে মাত্র আধ কেজি জোগাড় করতে পেরেছে সে। মহিলার হাতে পাঁচ শত টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দিয়ে টেম্পো ধরতে ছুটল অমল। শুনতে পেল পেছন থেকে মহিলা চেঁচাচ্ছে একটা নোট বেশি হয়ে গেছে, ফেরত নিয়ে যান। ছুটতে ছুটতেই অমল বলল, ‘রেখে দাও, মিষ্টি কিনে খেয়ো।’
ধান-টান নিয়ে অমল যখন ধানমণ্ডি এসে পৌঁছাল, তখন একুশ তারিখ বিকেল চারটা। ডেডলাইন রাইফেলের গুলি হলে বলা যেত সময়সীমা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
এগারো
মৃণাল বাবুর সঙ্গে হলঘরে দেখা হলো অমলের। সরাসরি ধানের পোঁটলাটা তার সামনে টেবিলের ওপর রেখে বলল অমল, ‘এই হলো আপনার ডুমাহি ধান। দেখে নিন ঠিক আছে কি না।’
‘আপনি ডেলিভারি নেয়ার সময় খুলে দেখেননি?’
‘না, দেখিনি। সময় ছিল না।’