‘এই ধান দিয়ে কী হবে? তা ছাড়া, এই ধান তো কাছে- পিঠেও কোথাও পাওয়া যেতে পারে। অতদূর যেতে হবে কেন?’
‘এই ধানের ফলন অত্যন্ত কম। গাছে থাকা অবস্থাতেই ঝরে যায় বেশির ভাগ। ওই ধান এখন আর খাওয়ার জন্যে চাষ করা হয় না। এর চাষ হয় শুধুমাত্র পুজোয় ব্যবহার করার জন্যে। আর ওই কাজটা কেবল খাসিয়ারাই করে। ধান দিয়ে কী হবে, সেটা পরে জানবেন। মন্দাকিনীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে রওনা হয়ে যান। যাওয়ার আগে ফর্মগুলো সই করে ওর হাতে দিয়ে যাবেন। আর একটা কথা, একুশে ডিসেম্বর বিকেলে আপনাকে অবশ্যই রিপোর্ট করতে হবে। রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হলে সব চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে চলে যাবে আপনার চাকরিটাও। আর যা-ই করেন, ধান আনতে ভুলবেন না।’
.
অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পৌঁছাল অমল। তারপর লোকাল বাস ধরে গাবতলী। পাটুরিয়ায় নিজ গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। মানিকগঞ্জ থেকে বড় ইলিশ মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি, মা-বোনের জন্যে কাপড়, ছোট দুই ভাইয়ের জন্যে বাটার জুতো-স্যাণ্ডেল এইসব কিনে হুলস্থুল করেছে। বাসে আসতে আসতে ভেবে দেখেছে অমল। দুই লাখ টাকা অনেক টাকা। বহু সমস্যার সমাধান এই টাকায় হবে। আদৌ যদি আর অফিসে ফিরে না যায় সে, তা হলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। যদিও আয়ু বিক্রির বিষয়টা একেবারেই হাস্যকর। গেলেও ক্ষতি নেই। তারপরেও কী দরকার এসব ঝামেলার? মৃণাল বাবু মরলেই কী আর বাঁচলেই কী?
নয়
পরদিন সকালে ইলিশ মাছ ভাজি আর মসুরির ডাল ঘাঁটা দিয়ে গরম ভাত খেয়ে বিমলকে সঙ্গে নিয়ে মানিকগঞ্জ কোর্টে গেল অমল। দেখা করল তার বাবার পরিচিত, উকিল অপূর্ব কুমার নন্দীর সঙ্গে। কেসের নোটিশ, কাগজপত্র সব দেখে অপূর্ব বাবু বললেন, ‘শোনো, অমল, তোমার জ্যাঠা শৈলেনকে আমি চিনি। কেস-কাচারি করে করে পেকে ঝুনো হয়ে গেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দেয়া খুব কঠিন। এই মামলা যদি জিততেও পারো, তবুও দেখবে কেস চালাতে গিয়ে ভিটে-মাটি বিক্রি করতে হয়েছে। আমি বলি কী, কিছু টাকা-পয়সা ওর হাতে দিয়ে মিটমাট করে নাও। ওকে বলো, কেসটা তুলে নিয়ে জমি-বাড়ি তোমাদের নামে লিখে দিতে। আজ বাড়ি ফিরে যাও। ভেবেচিন্তে দেখো। যদি মামলা লড়তেই চাও, তা হলে কাল এসো। তখন দেখব।’
বাড়ি ফিরে বিকেলের দিকে মাকে নিয়ে জ্যাঠার সঙ্গে দেখা করল অমল। জ্যাঠা কেস উঠিয়ে নিতে রাজি। জমিও লিখে দেবে, তবে তার জন্যে নগদ চার লাখ দিতে হবে। পরিবারের ভেতরে বলেই এত কম! বাইরের লোক হলে দশ লাখের নিচে হত না। রাতে বিছানায় শুয়ে পরদিন কীভাবে সুনামগঞ্জ যাবে, অমল ভাবতে লাগল সেই কথা।
দশ
বাসে করে সিলেট শহরে পৌঁছতেই রাত হয়ে গেল। দরগা গেটের এক হোটেলে উঠল অমল। সুনামগঞ্জের বাস ছাড়ে আম্বরখানা নামের এক জায়গা থেকে। হোটেল থেকে ওয়াকিং ডিসট্যান্স। ঝরঝরা লোকাল বাসে চড়ে সুনামগঞ্জে গিয়ে যখন উঠল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। মৃণাল বাবু যে জায়গার কথা বলেছিল, তা তখনও চল্লিশ মাইল দূরে। ওই জায়গার নাম ট্যাকের ঘাট। বর্ষাকালে যাওয়া সহজ। হাওড় পাড়ি দিয়ে লঞ্চে কিংবা ইঞ্জিন লাগানো নৌকোয় হাওয়া খেতে-খেতে ওপারে গেলেই হলো। যত সমস্যা শুকনোর সময়। হাওড় শুকিয়ে কাদা। মাঝে-মধ্যে আবার গভীর জলাশয়। হেঁটে-সাঁতরে যদিও বা যাওয়া যায়, তবে ওপারে পৌঁছতে কত সময় লাগবে, ভগবান জানেন। হাওড়ের রুট বাদ দিলে বিকল্প পথ হলো ভারতীয় বর্ডারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা সরু রাস্তা। রাস্তা না বলে ট্রেইল বলাই ভাল। ট্রেইল যেখানে চওড়া সেখানে রিক্সা-ভ্যান, টেম্পো চলে। বাকিটা হয় হাঁটো, না হয় সাইকেল চালাও।
ওবেলায় সেই জায়গায় যাওয়ার সাধারণ যানবাহন সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাতটা সুনামগঞ্জের ছারপোকা বোঝাই বেড়অলা বোর্ডিং-এ প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে ভটভটি টেম্পোয় চড়ে রওনা হলো অমল।
ঝাঁকি-ধুলো বাদ দিলেও টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় চোখে- নাকে জলের বান ডাকল। নানান তাল করতে-করতে ট্যাকের ঘাটে অমল যখন পৌছাল, তখন সূর্য পাটে বসেছে। খাসিয়া মেয়েরা খড়ি-লাকড়ি বেচে, বাজার-সদাই করে ফিরে গেছে যে যার বাড়িতে। তারা আবার আসবে পরদিন সকালে। রাস্তা ঘেঁষা বিশাল এক রেইনট্রি গাছের নিচে বসল অমল। পশ্চিমে টাঙ্গুয়ার হাওড়। উল্টো দিকে এক চিলতে জমির ওপর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত কয়েকটা হাফ বিল্ডিং, জং-ধরা লোহার ট্রলি, ঘাস-গজানো রেলওয়ে ট্র্যাক, আদ্যিকালের মরচে-পড়া ইয়া বড়-বড় সব ক্রেন, স্বচ্ছ নীল জলের ছোট্ট একটা সরোবর। সমতল জমিনটার পরেই আদিগন্তবিস্তৃত ঘন গাছপালা ঢাকা আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারিতে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলো। ছবির মত সুন্দর জায়গাটা দারুণ রকম নীরব চারদিকে কী যেন নেই ভাব। জীবন আর সময় দুটোই থমকে গেছে এখানে। এ যেন ইহজাগতিক ব্ল্যাক-হোল। অনন্তকাল ধরে সব কিছু একই রকম। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কম্পাউণ্ডের পরেই ঘাসে ঢাকা বিশাল এক খালি মাঠ। মাঠ পেরিয়ে ছোট মহল্লায় একতলা-দোতলা টিনের বাড়ি। মহল্লার ওপারে বাজার, মসজিদ। কিছুক্ষণ বসে থেকে বাজারের দিকে রওনা হলো অমল।