‘তা না হয় হলো। কিন্তু আপনি তো হুমায়ুন না, আমিও বাবর না। তা ছাড়া, আপনি বিছানায় শুয়ে মরার জন্যে অপেক্ষাও করছেন না।’
‘বাইরে থেকে তা-ই মনে হয়। ভেতরে ভিন্ন চিত্র। আমার দেহে বিচিত্র রোগ বাসা বেঁধেছে। এই অসুখের নাম সিস্টেমিক ক্লেরোসিস। আমার হাত আর মুখের অবস্থা দেখেছেন? কুষ্ঠ রোগীর সব লক্ষণ ওখানে আছে। চামড়া শুকিয়ে শক্ত হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে। চামড়ার রঙ হয়েছে শ্বেতী রোগীদের মত। কিছুদিন পর ঠোঁট, নাকের পাটা, চোখের পাতা, কানের লতি সব বিলীন হয়ে যাবে। ঠেকানোর কোনও রাস্তা নেই। এ এক ভয়াবহ রোগ। এ রোগে শরীরের ইমিউন সিস্টেম দেহকে রোগের হাত থেকে রক্ষা করার বদলে শরীরকেই আক্রমণ করে বসে। কুষ্ঠের চিকিৎসা আছে, কিন্তু এর নেই। বাইরে যেমন দেখছেন, ভেতরে হার্ট এবং লাঙের অবস্থাও অমনই। ইউরোপ- আমেরিকার বড়-বড় সব ডাক্তার দেখে জবাব দিয়ে দিয়েছে। মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং সেটা ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। ছ’মাস আগে দেশে এসেছি শেষ চেষ্টাটা করার জন্যে।’
‘শেষ চেষ্টাটা কি অন্যের কাছ থেকে আয়ু নেয়া?’
‘এগজ্যাক্টলি।
‘কিন্তু এত দেশ থাকতে এখানে কেন?’
‘টাকা ছড়ালে এখানে সব করা সম্ভব। তা ছাড়া, কাজটা আমি করতে চাচ্ছি ভারতীয় দেবীর সহায়তায়। কৃষ্ণ-জাদুর চর্চা করে কোনও দেবীকে একবার ডেকে আনলে তাঁকে আর দ্বিতীয়বার ডাকা ঠিক না। সাড়া না-ও দিতে পারেন। আর যদি দেনও, জীবন সংশয় হতে পারে।’
‘অসুখটা বাধালেন কী করে?’
‘সিরাসের সঙ্গে পুরনো সব দেব-দেবীর মূর্তির খোঁজে দুনিয়ার নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। ঘুরতে হয়েছে লোকালয় থেকে বহুদূরে সমাধি চত্বরে আর মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে। আমরা একবার গেলাম লিবিয়ার গাদামিসে মেডিটেরিনিয়ানের কাছেই তিউনিসিয়া-আলজেরিয়া বর্ডারে। সিরাসের কাছে পাকা খবর ছিল ওখানে অ্যানুবিসের এক প্রাচীন মন্দিরে সাইমন মেগাসের লেখা অমূল্য পার্চমেন্ট আছে। এই সাইমন মেগাস যিশু খ্রিস্টের আমলে ইজরাইলের সব থেকে বড় জাদুকর ছিল। সামারিয়া এলাকার সব লোককে কালো জাদুর প্রভাবে বশীভূত করে রেখেছিল এই সাইমন। ‘ঊষর মরুভূমির ভেতর গাদামিস এক অদ্ভুত শহর। বাড়ি-ঘর, মন্দির, রাস্তা-ঘাট সব মাটির নিচে। হাজার-হাজার বছর ধরে তিল-তিল করে লক্ষ-লক্ষ লোক গড়ে তুলেছিল ওই নগরী। অ্যানুবিসের মন্দির খুঁজে বার করে আমরা যতদিনে ঢুকলাম, ততদিনে পার্চমেন্ট হাওয়া। মন্দিরের গর্ভগৃহে অ্যানুবিসের ইয়া বড় মূর্তি। মূর্তির পায়ের নিচে গোল-গোল অনেকগুলো খোপ। বোঝাই যাচ্ছে ওগুলোতে পার্চমেন্ট স্ক্রোল রাখা হত। কী মনে হলো, একটা খোপে হঠাৎ করেই হাত ঢুকিয়ে দিলাম। ভেতরে ধুলো-বালি, মাকড়সার ঝুল। আর কিছুই নেই। হাত বের করে আনছি, এমন সময় টের পেলাম কুট করে কীসে যেন কামড়ে দিল। হাত বাইরে আলোয় এনে দেখি কালো কুচকুচে পিঠঅলা বিট্ট্ল বসে আছে তালুর ওপর। মাথায় ত্রিশূলের মত শিং। দু’দিকে দুটো দাঁড়া। দাঁড়ার শেষ প্রান্তে মানুষের আঙুলের মত আঙুল। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন সিরাস। বুঝলাম ঘটনা দেখে ঘাবড়ে গেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসেন সিরাস। পরদিনই আমেরিকায় ফিরে যাই আমরা। সিরাস আমাকে জানান, ওই বিলগুলোকে বলা হয় মেগাসোমা অ্যানুবিস। অতি বিরল প্রজাতির বিল। ওগুলো কাউকে কামড়ালে মৃত্যু অনিবার্য। ধরা হয় দেবতা অ্যানুবিসের অভিশাপ পড়েছে তার ওপর। এরপর কেটে গেছে দুই বছর। সিরাস মারা গেলেন। আমি পড়লাম অসুখে। ব্ল্যাক আর্টের চর্চা অনেক কিছু দেয় ঠিকই, তবে বিনিময়ে কেড়ে নেয় জীবনটাকেই!’
‘আপনার সব কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে মাত্র দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আপনি আমার আয়ু থেকে দশ বছর নিয়ে নেবেন, তাই তো? টাকাটা পাব কখন?’
‘প্রস্তাবে রাজি হলে দুই লাখ টাকা এখনই পাবেন। কাজ শেষ হলে আরও আট লাখ। মোট দশ লাখ নগদ। তবে সাবধানের মার নেই। আপনার জীবন বীমা করিয়ে রাখতে চাই। যদি কোনও কারণে দ্রুত মারা যান, তা হলে আপনার নমিনি পাবে আরও দশ লাখ। পলিসি কেনা হয়ে গেছে। আমার হাতে যে ফর্মগুলো দেখছেন, ওগুলোতে যদি সই করেন, তা হলে আজই অ্যালিকোয় পলিসি খোলা হয়ে যাবে। এখন বলেন, আমার প্রস্তাবে রাজি আছেন কি না।’
‘আমি রাজি। কী করতে হবে বলেন।’
‘আজ ডিসেম্বরের তেরো তারিখ। আপনাকে সাত দিনের ছুটি দেয়া হবে। এর ভেতর যদি ইচ্ছে হয় বাড়ি যেতে পারেন। তবে অন্য একটি কাজ আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। সেটি হলো সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাওয়া। হাওড় পার হলে পুব দিকে ভারত সীমান্ত। মাত্র তিন শ’ গজের একফালি সমতল জমি বাংলাদেশকে ভারত থেকে আলাদা করেছে। ওই জায়গাটাতে ওপারের পাহাড় থেকে খাসিয়া মেয়েরা পিঠে খড়ির বোঝা এনে বিক্রি করে। হাওড় অঞ্চলে গাছ নেই। এই খড়ি জ্বেলেই রান্নাবান্না করে ওখানকার লোকেরা। খাসিয়া মেয়েরা খড়ি বেচে যে টাকা পায়, তা দিয়ে ওখান থেকে বাজার-সদাই করে আবারও ফিরে যায় তাদের পাহাড়ি গ্রামে। এই খাসিয়া মেয়েগুলোর মাধ্যমে এক বিশেষ জাতের ধান সংগ্রহ করবেন। এই ধানের নাম ডুমাহি। ধরা হয় এটাই পৃথিবীর প্রথম ধান। উৎপত্তিও ওই হাওড় অঞ্চলেই। কম করে হলেও দশ হাজার বছরের পুরনো এই ধান। তুলনাহীন এর স্বাদ। ছিন্ন-মস্তা অহম উপজাতীয়দের দেবী। হাজার হাজার বছর আগে প্রথম যখন এই দেবীর উদ্ভব হয়, তখন এই ধানের অর্ঘ্য দিয়েই তাকে তুষ্ট করত পূজারীরা। টাকা যা চায়, দেবেন। খাসিয়ারা সৎ। উল্টো-পাল্টা ধান গছিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ডুমাহি পাওয়া কঠিন।’