.
পরদিন ভোরে উঠে নাস্তা সেরে হেঁটে হেঁটে তার ‘অফিসে’ গেল অমল। আসার পথে বিস্তর ভাবনা-চিন্তা করেছে সে। বাড়ি যাওয়া দরকার। জ্যাঠার সঙ্গে কোনও রফা করা যায় কি না, দেখতে হবে। জমি-জাতি বেচে অন্তত ঋণটা শোধ করা প্রয়োজন।
ঠিক ন’টায় গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অমল। দারোয়ান বলল, ‘মেম সা’ব কা অফিস মে যাইয়ে।’
মন্দাকিনীর সঙ্গে দেখা হতেই একতাড়া ফর্ম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ক্রস মার্ক করা জায়গাগুলোতে আপনার সই লাগবে। ওগুলো নিয়ে স্যরের কাছে যান। ওঁর সঙ্গে কথা বলে তারপর সই করবেন।’
বড় হলঘরটাতে মৃণাল বাবু আগের মতই সোফায় বসা। অমলকে ইশারায় বসতে বলল।
‘অমল বাবু, আপনাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে। বাড়ির সব খবর ভাল তো?’
ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল অমল। লোকটা ভয়ানক বুদ্ধিমান। সব সমস্যা ঝেড়ে-ঝুড়ে বলার এখনই সময়। মৃণাল বাবুকে সব কিছু খুলে বলল সে। মৃণাল বাবু বলল, ‘আমার তো মনে হয় আপাতত লাখ দুয়েক টাকা হলেই চলবে। আপনি চাইলে টাকাটা নিতে পারেন। তবে শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?’
‘আমি যা যা বলব, আপনাকে সেইমত কাজ করতে হবে।’
‘আপনার কথা মতই তো কাজ করছি। নতুন করে আবার কী কাজ করতে হবে?’
‘পুরো বিষয়টা আপনাকে এখনও বলা হয়নি। সব কিছু শুনে চিন্তা-ভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। একবার রাজি হলে আর পিছাতে পারবেন না।’
‘খুন-খারাবির ভেতর আমি নেই। অন্য কিছু করতে বললে ভেবে দেখতে পারি।’
‘আরে নাহ্। এসব কিছু না।’
‘আচ্ছা, বলেন, কী আপনার শর্ত?’
‘আপনার জীবন থেকে কিছুটা আয়ু আমাকে দিয়ে দিতে হবে।’
‘এ আবার কী শর্ত! আয়ু আবার ধার দেয়া যায় নাকি?’
‘হয়তো যায়, হয়তো যায় না। না গেলে নাই। আর যদি যায়, তা হলে আপনি দেবেন কি না?’
‘এ তো মনে হচ্ছে পাগলের শর্ত।’
‘বাবু, আপনি রাজি আছেন কি না সেইটে বলেন। পাগলের শর্ত, না ইন্টেলেকচুয়ালের কণ্ডিশন সেটা শর্ত যে দিচ্ছে তাকে বুঝতে দেন।’
‘ঠিক আছে, শর্ত মানতে রাজি আছি আমি। কয় বছরের আয়ু ধার দিতে হবে?’
‘ধার না। একেবারে দিয়ে দিতে হবে। নন-রিফাণ্ডেবল।’
‘আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু কয় বছরের?’
‘দশ বছরের।’
‘বেশ, তা না হয় হলো। কিন্তু আমার দশ বছরের আয়ু কার দরকার? আর নেবেই যখন আরও বেশি করে নিচ্ছে না কেন? দশ বছর খুব বেশি সময় তো না।’
‘আপনার আয়ু আপনি দেবেন আমাকে।’
এবার অমল সত্যিই অবাক হলো। মৃণাল বাবুকে খুব হাই লেভেলের পাগল বলে মনে হচ্ছে। এদেরকে ঠিক পাগল বলা যায় না। এরা হচ্ছে ম্যানিয়াক। কোনও তত্ত্ব একবার যদি বিশ্বাস এরা করেছে, তা হলে যত অসম্ভব আর অযৌক্তিকই সেটা হোক না কেন, সেখান থেকে তাদের ফেরানো যাবে না কিছুতেই। মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পাতন। এরা হচ্ছে এই গোত্রের।
‘অমল বাবু, আপনি কী ভাবছেন আমি জানি। ধরে নেন আমি পাগল কিংবা ম্যানিয়াক। তাতে আপনার অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না। ভেবে দেখেন, টাকার জন্যে মানুষ রক্ত, চোখ, কিডনি, দেহ, কত কিছু বিক্রি করছে। জীবন সংশয় হচ্ছে। আপনি শুধু বিক্রি করছেন আয়ু। তা-ও দশ বছরের। যত টাকা আপনার দরকার, সেটা শুধু কিডনি বিক্রি করলেই জোগাড় হতে পারে। কিডনি বিক্রি করলে অপারেশন থিয়েটারেই মারা যেতে পারেন। সেখানে না মরলেও পরে যে-কোনও সময় মরতে পারেন।’
‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার আয়ু আদৌ দশ বছর আছে কি না, সেটাই বা কীভাবে জানা যাবে? যে-কোনও সময়ই যে কেউ মরতে পারে।
‘স্বীকার করছি সেই ঝুঁকি আছে। তবে ক্যালকুলেটেড রিস্ক বলে একটা কথা আছে। আপনার ঠিকুজি-কুলজি নিয়ে গত দু’মাস গবেষণা করেছি। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া কাকতালীয় নয়। তারপরেও যেটুকু সন্দেহ ছিল, চাকরির দরখাস্তে আপনি যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে দূর হয়েছে।’
‘আপনি তা হলে পার্কে যেতেন আমাকে খুঁজতে! মাথা বানানো, ধাঁধা জিজ্ঞেস করা স্রেফ অজুহাত?’
‘বিষয়টা সেই রকমই। তবে সেই লোক যে আপনিই হবেন, তা জানতাম না। গ্রহ-নক্ষত্রের বিচারে যাকে দিয়ে কাজ হবে, সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়ার সব থেকে বেশি সম্ভাবনা ছিল ওখানটাতেই, বছরের এই সময়ে, জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি। দরকার ছিল লক্ষণ আর গুণ বিচারের। ধাঁধা জিজ্ঞেস করে গুণ বিচার করা অতি পুরনো গ্রিক রীতি। এডিপাস আর স্ফিংসের ঘটনাটা মনে করে দেখেন। এসবই আমার গুরু সিরাসের কাছ থেকে শেখা। তবে আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন? আপনিও জাতে হিন্দু এবং আমাদের বংশের লোক। বহুকাল আগে আমার-আপনার একই পরিবার ছিল।’
‘বুঝলাম, আমরা একই বংশের, মান্ধাতার আমলে পরিবারও একটাই ছিল, কিন্তু কী লাভ হচ্ছে?’
‘আপনি বাবর আর হুমায়ুনের ঘটনা তো জানেন। ছোট বয়সে হুমায়ুন মরতে বসেছিল। সে যখন সব চিকিৎসার বাইরে, আজরাইল কখন আসে সেই অপেক্ষায়, তখন এক সুফি সাধক বাবরকে বললেন হুমায়ুনের জীবন বাঁচাতে হলে তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিস, সেইটে কুরবানি করতে হবে। বাবরের মহামূল্যবান জিনিস মাত্র তিনটি: কোহিনূর হীরে-যেটা তিনি ইতিমধ্যে হুমায়ুনকে দিয়ে দিয়েছেন, তাঁর রাজ্যপাট, এবং নিজের জীবন। বাবর ভেবে দেখলেন শেষেরটির মূল্যই সব থেকে বেশি। কুরবানি করতে হলে ওটাকেই করতে হবে। সুফির নির্দেশে বাবর হুমায়ুনের খাটের চারদিকে তিন পাক ঘুরলেন। ঘোরার সময় মনে-মনে বললেন, হে, করুণাময়, আপনি আমার আয়ু, আমার জীবন আমার ছেলেকে দিয়ে দিন এবং তার অসুখ আর মৃত্যু আমাকে দিন। বাবর এই কাজ করলেন মাগরেবের আযানের সময়। পরদিন ফজরের পর থেকেই হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু বাবর আর বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। তাঁর সব আয়ু তিনি হুমায়ুনকে দিয়ে ফেলেছেন। আত্মীয়তার টান অনেক বড় জিনিস রে, ভাই।’