‘সিরাস লিওনার্দের পুজো করতেন তার যৌন-লালসা নিবারণের জন্যে। সিরাসের অধ্যাপনা ছিল আসলে লোক দেখানো। নিউ অর্লিন্সের সেরা ধনী এই লোক। তাঁর নামে কোটি কোটি ডলারের অফশোর অ্যাকাউন্ট। দারুণ বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতেন ভদ্রলোক। তবে সবই চলত আড়ালে আবডালে। তাঁর শিকার হত টিন এজার আর কুমারী মেয়েরা। লাখ-লাখ ডলার খরচা হলেও সিরাস নিয়মিত এদের বিছানায় তুলবেনই। আগেই বলেছি, সিরাস ছিলেন ধূর্ত শিরোমণি। তাঁর নীতি হলো একলা চলো রে। অবশ্য তাঁর অধ্যাপনার আরও একটা কারণ ছিল। কালো জাদুর চর্চা এক চলমান প্রক্রিয়া। যত বেশি গবেষণা তত বেশি উন্নতি। রিসার্চ অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট ছাড়া দুনিয়া অচল।’
ফাঁক পেয়ে অমল আবার বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, স্যর। সিরাসের নীতি যদি একলা চলো রে-ই হবে, তা হলে আপনাকেই বা নিলেন কেন? আর নেবেনই যদি, তো আপনি ছাড়া আরও লোক ছিল না?
‘অতীতে হয়তো সাহায্যকারী কেউ ছিল। আমার সঠিক জানা নেই। তবে আমাকে বেছে নেয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল আমার অদম্য আগ্রহ এবং আমি ভিন দেশি। ওদেশে আমার কেউ নেই। বিদেশি ছাত্র যদি দুই-দশটা নিখোঁজও হয়, তবুও কেউ কেয়ার করবে না। তখন বাংলাদেশ কেবল স্বাধীন হয়েছে। সব কিছু এলোমেলো। ওদেশে গিয়েছিলাম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে। আমি আসলে কোন্ দেশের সেটারই ঠিক নেই। সিরাস এসব জানতেন। আমার চেয়ে উত্তম সহযোগী আর কোথায় পাবেন তিনি? যা হোক, পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সিরাসের প্রধান উপাস্য ছিল দেবী হেকাটি। এর মূর্তির দু’দিকে দুই পিশাচী। মাথায় মোষের শিঙের মত অর্ধেক চাঁদ। চাঁদের ভেতর ছয় কোণের একটি তারা। দেবীর এক হাতে মশাল, অন্যহাতে চাবি, দাঁড়িয়ে আছে তিন রাস্তার মোড়ে। চাবি হলো সম্পদের প্রতীক, মশাল জীবনের। এর আরাধনা করতে হয় ঘোড়া আর কুকুর বলি দিয়ে। শর্ত হলো পুজোর সব আয়োজন করতে হবে তিন রাস্তার মোড়ে রাতদুপুরে। একজনের পক্ষে সব কিছু সম্ভব না। একাজে কমপক্ষে দু’জন লাগবে। যে মূর্তির সামনে বলি চড়ানো হবে, সেইটে হতে হবে অতি প্রাচীন। তারপর দরকার জটিল সব মন্ত্র। এই মন্ত্রের ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে বহু কাল আগেই।’
‘আপনি সিরাসকে সাহায্য করেছিলেন?’
‘তা তো বটেই।’
‘ব্যাপারটি খুলে বলবেন?’
‘আজ এ পর্যন্তই। এর বেশি কিছু জানার আপনার দরকার নেই। এই ভূমিকাটুকু না জানলে পরের কাজগুলোর গুরুত্ব আপনি বুঝতে পারবেন না। ওটাই এতকিছু বলার কারণ। আজকের মত বাসায় ফিরে রেস্ট নেন। কাল আসবেন।
অমল লক্ষ করল কথা বলতে বলতে ঘেমে নেয়ে গেছে মৃণাল বাবু। নেতিয়ে পড়েছে সোফার ওপর। মেসের দিকে রওনা হলো অমল। গুলিস্তানের ছোট পার্কে বসবে কি না ভাবছে। রেখা মেয়েটার কথা মনে পড়ছে খুব। কিন্তু সমস্যাও আছে। কামাল দেখে ফেলতে পারে। তিনে তিনে ছয় মেলাতে তার তখন সময় লাগবে মাত্র এক সেকেণ্ড। সাত-পাঁচ ভেবে মেসে ফিরে গেল অমল। মেসে ফিরতেই অমলের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন বিনয় বোস। পৃথিবীতে কিছু লোক আছে, যারা সব কিছুতে শুধু খারাপটাই দেখতে পায়। বোস বাবু যে দৃষ্টিতে অমলের দিকে তাকালেন, সেই দৃষ্টির ভাষা এমন: নিজেই খেতে পাস না। এখন দেখ তোর বাড়িতে কী ছুঁচোর নেত্য হচ্ছে। চিঠি খুলে পড়। তারপর বুঝবি কত পাটে কত দড়ি। যত্ত সব ফকির মিসকিনের দল।
রুমে গিয়ে চিঠি পড়ে অমলের চোয়াল ঝুলে পড়ল। তাদের জ্যাঠা মশাই মানিকগঞ্জ কোর্টে কেস করেছেন। ঠাকুরদা নাকি মৃত্যুর আগে অমলদের বাড়ি সহ চার বিঘে জমি জ্যাঠার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। রেজিস্ট্রি করা আমমোক্তারনামা আছে। অমলদের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা রুজু করেছেন জ্যাঠা। আপাতত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে। সাত দিনের ভেতর জবাব দাখিল করতে হবে। না হলে একতরফা রায় হয়ে যাবে। নিষেধাজ্ঞার মামলায় নানান ফ্যাকড়া থাকে। এ হলো সিঁড়ি- ভাঙা অঙ্ক। লোয়ার কোর্ট, জজ কোর্ট, হাই কোর্ট করে যদি বা অস্থায়ী নাকচ করা যায়, তারপরও স্থায়ী থাকে। আবারও সেই সিঁড়ি-ভাঙা। জলের মত টাকা খরচ, এন্তার দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু তার বিনিময়ে প্রাপ্তি যৎসামান্য। ওদিকে ছেড়ে দিয়ে বসেও থাকা যাবে না। নইলে ভিটে-মাটিছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। দুঃসংবাদের এখানেই শেষ নয়। অমলের ছোট ভাই বিমল ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বাড়ির পেছনে ব্রয়লার মুরগির খামার করেছিল। সেই সময় আশপাশের অনেকেই ব্রয়লার চাষ করে দু’পয়সা কামাচ্ছিল। মাস ছয়েক আগে বার্ড ফ্লু না কী একটা ভাইরাসে সব মুরগি সাবাড়। কেউ-কেউ মুরগি বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল এবং বলা যায় প্রায় সফলও হয়েছিল, কিন্তু সরকার ওসব কেয়ারই করেনি। যেখানে যা মুরগি ছিল, পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে সব মেরে গর্তে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করেছে। এখন ক্ষুদ্র ঋণঅলারা সুদ সহ বকেয়া ফেরত চাচ্ছে। এক লাখের ভেতর বিমল পঞ্চাশ শোধ করেছিল। এখনও পঞ্চাশ বাকি। সুদের যে হার, তাতে সুদ যে কত হয়েছে তা ভগবান জানেন! ওদিকে মায়ের ডায়াবেটিস, শ্যামলের (বিমলের ছোট) হার্নিয়া অপারেশন! দুপুরে কোনও কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল অমল। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। চোখ খুলে রাখার শক্তিটাও নেই।