‘পুরাণের অনেক বর্ণনা-টর্ননা পড়ে হিমেল স্যর ছিন্ন- মস্তার ছবি এঁকেছিলেন। ওই ছবি একবার দেখলে যে-কারও সারাজীবন মনে থাকবে। ছবিটা ছিল এরকম: দেবীর বাঁ হাতে পিশাচের জিভ, ডান হাতে শাল কাঠের শক্ত লাঠি। ছিন্ন-মস্তা নিজেই নিজের মাথা কেটে এক হাতে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে সাপের জিভের মত দুই-মাথাঅলা খঞ্জর। কাটা গলা থেকে তিনটি ধারায় ঝরনার মত রক্ত বেরিয়ে আসছে। দেবীর দুই পাশে দাঁড়ানো দুই পিশাচী। কাটা মাথা আর দুই পিশাচী পান করছে সেই রক্ত। দেবী দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গমরত এক যুবক-যুবতীর ওপর। যৌনাঙ্গ- বিদ্ধাবস্থায় এলো চুলে পায়ে নূপুর পরা সম্পূর্ণ নগ্ন, ফর্সা ধবধবে স্বাস্থ্যবতী যুবতী ওপরে, মাথায় মুকুট আর হাতে বাজুবন্ধ পরা কালো কুচকুচে দিগম্বর যুবক নিচে। যুবক ধরেছে যুবতীর সুডৌল স্তন, যুবতী যুবকের গলা। এরা সঙ্গম করছে এক ত্রিভুজের ভেতর। ত্রিভুজটা আঁকা হয়েছে একটা বৃত্তের মধ্যে। বৃত্তটা আবার সাদা-গোলাপি ইয়া বড় একটা পদ্মফুলের ওপর আঁকা। পিশাচীদের একজন ধবধবে সাদা, অন্যজন ঘোর কৃষ্ণকায়। এদের মাথার উপর আকাশে উড়ছে দুটো-দুটো করে চারটে শকুনি। দেবী এবং পিশাচীদের গলায় নরমুণ্ডের মালা। পিশাচীদের এক হাতে সাদা মাটির গামলা, অন্য হাতে দুই মাথাঅলা খঞ্জর। দেবী বা পিশাচী পুরোপুরি নগ্ন। রক্তে মাখামাখি দেবীর বুক-পেট। সেই রক্ত ঊরুসন্ধি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। পুরো ব্যাপারটিই ঘটছে কৃষ্ণপক্ষের মাঝরাতে একটা শ্মশান ঘাটে।
‘স্যরের আঁকা বগ্লামুখী আর ছিন্ন-মস্তার ছবি দেখার পর এদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। মনে হলো জাদুবিদ্যা শিখতে হলে এদের অনুগ্রহ অবশ্যই দরকার। এই দেবীদের ব্যাপারে যেখানে যা লেখা আছে, পড়তে শুরু করলাম। অর্থাৎ; কীভাবে এদের আরাধনা করা যায়, সেইটে জানা। বগ্লামুখীর নিজস্ব মন্দির নেই বললেই চলে। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে আদ্যিকালের এক মন্দির কমপ্লেক্সে ছোট্ট একটা অংশে এই দেবীর অধিষ্ঠান। ছিন্ন-মস্তার মন্দিরেরও ওই একই অবস্থা। আসামের গোহাটির কামাখ্যা মন্দিরে ছিন্ন- মস্তার সাধনপীঠ। তখন পাকিস্তান আমল। বাবা আমার পীড়াপীড়িতে রাজি হলেও কর্ণাটক কিংবা আসামের গোহাটিতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমার ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তি হওয়ার। বাবা রাজি হলেন না। তাঁর ইচ্ছে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সাবজেক্টের ব্যাপারে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। আমি ভর্তি হলাম টুলেন ইউনিভার্সিটিতে। পরদাদার আমলের তৈরি দু’ শ’ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। সাবজেক্ট, ডিসিপ্লিনের অভাব নেই। প্রথম সেমেস্টার ফাইন আর্টসে ক্লাস করলাম। দ্বিতীয় সেমেস্টারে উঠে ডিসিপ্লিন বদলে ভর্তি হলাম কম্পারেটিভ রিলিজিয়ান স্টাডিজে। এর পেছনে ছোট্ট একটা ঘটনা আছে। নিউ অর্লিন্সের আবহাওয়া বাংলাদেশের মতই। তবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাঝে- মধ্যে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়। আমার ক্লাস শুরু হয়েছিল অগাস্টের শেষে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে সেমেস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। শুরু হবে ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের ছুটি। একদিন শুক্রবারে দুপুর বারোটা থেকে চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে ডর্মে ফিরছি। ভাবলাম ক্যাফেটেরিয়া থেকে এক কাপ কফি কিনে খাই। যে বিল্ডিং-এ ক্যাফে, সেখানে গিয়ে দেখি রড-লাইটের আলোয় হাহা করছে ক্যাফে। একটা লোকও নেই। শুক্রবার বলে কথা। উইক-এণ্ড শুরু। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আবার যখন রাস্তায় নামলাম, তখন কড়কড় বাজ পড়ছে। শুরু হলো প্ৰচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। এ কালবৈশাখীর বাবা। আঁধার হয়ে এল চারদিক। যেন সূর্য-গ্রহণ চলছে। চার শ’ বছরের প্রাচীন শহর নিউ অর্লিন্স। কবল-স্টোন রাস্তা, অসংখ্য গলিঘুপচি। বাড়ি-ঘর ওই চার শ’ বছর আগে যেমন ছিল, এখনও বলতে গেলে তেমনিই আছে। ভাঙা হয়নি কিছুই। যখন যতটুকু দরকার মেরামত করেই চালানো হচ্ছে।
‘আমেরিকানদের কাছে নিউ অর্লিপ্স ভূত-পিশাচদের শহর। এখানকার মোড়ে মোড়ে উইচক্র্যাফট বা ডাকিনী বিদ্যার চর্চা হয়। গভীর রাতে চলে পিশাচ সাধনা। ওখানকার শহরগুলোতে ধুলো-বালি নেই। তারপরেও বাতাসের তোড়ে চোখ খোলাই যাচ্ছে না। মূল রাস্তা বিরাট চওড়া। কিন্তু হলে কী হবে, রাস্তা পেরোলেই মিসিসিপি নদী। চওড়ায় পদ্মার সমান। কূলের কাছেই কলকল করছে জল। এই রকম ঝড়ের সময় নদীতে বান ডাকে। তখন ওদিকে যাওয়া মানা। মার্ক টোয়েনের সব বইয়ে এই নদীর ভয়াবহতার কথা আছে। বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকলাম গলির ভেতর। মাথা নিচু করে দৌড়াচ্ছি। কোনদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছি কিচ্ছু জানি না। তখন পর্যন্ত ওই শহরের কিছুই চিনি না। যা হোক, গলির ভেতর ঝড়ের তাণ্ডব কম। ভিজে সপসপ করছে সারা গা। কোনও এক জায়গায় না থামলেই নয়। হঠাৎ সামনে দেখলাম লোহার খুঁটিঅলা চওড়া বারান্দা। বারান্দা পেরিয়ে কাঁচের জানালা-দরজা। ভেতরে আলো জ্বলছে। কোনও কিছু না ভেবেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। বুঝতে পারলাম, ওটা একটা উন্নতমানের পাব। বাইরে এত যে প্রলয়কাণ্ড অথচ ভেতরে মহাশ্মশান। না কোনও শব্দ, না কোনও বাতাস। একদিকে চওড়া কাউন্টারঅলা বার, অন্যদিকে সাদা টেবলক্লথে ঢাকা চারজন বসার জন্যে ছোট-ছোট ডায়মণ্ড শেপড টেবিল। প্রায় পনেরো-বিশজনের মত লোক বসে আছে টেবিলগুলো ঘিরে। স্যুট-টাই পরা মাঝবয়সী এক লোক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে রোস্ট্রামের পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওভারহেড ল্যাম্পের আলোয় বক্তা এবং বারই শুধু আলোকিত। হলের বাকিটা প্রায় আঁধার। খুবই কমন দৃশ্য। শহরের এখানে সেখানে এরকম অনেক পাব আছে। বিতর্কিত সব বিষয় নিয়ে পণ্ডিতেরা এসব জায়গায় লেকচার দেন। বাছাই করা কিছু অডিয়েন্সই শুধু এ ধরনের লেকচার শুনতে আসে। অডিয়েন্সের পেছন দিকে বাথরুম। সেখানে গিয়ে গা-মাথা মুছে পেছন দিকের একটা চেয়ারে বসলাম। দর্শক ডিঙিয়ে বারে গিয়ে ড্রিঙ্ক আনার সাহসই হলো না। লেকচার হচ্ছে প্রাচীন কালে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ধর্ম নিয়ে। সেকালে ধর্ম আর জাদুর ভেতর পার্থক্য ছিল না বললেই চলে। শেষদিকে লেকচার চলে গেল কালো জাদুর রিচুয়ালিস্টিক দিকগুলোতে। পশ্চিমা দেশের পণ্ডিতদের অন্যতম গুণ হলো, যে বিষয় নিয়ে তারা পড়াশোনা করে, সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান হয় অসাধারণ। ফাঁকিযোগী কিংবা জোড়াতালির দৃষ্টান্ত বিরল। লেকচার যা হলো, তার বেশিরভাগই বুঝতে পারলাম না। তবে যেটুকু বুঝলাম, মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাতেই।