‘যা হোক, এই গেরাদেহ্ ছিল পয়গম্বরের বিশেষ প্রিয় পাত্রী। তিনি দেখলেন গেরাদেহ্ রাতদিন তার বাবার জন্যে চোখের জল ফেলছে। মাঝে-মাঝে অবস্থা এমন হয় যে গেরাদের কান্নাকাটি আর থামতেই চায় না। মহাবিরক্ত হয়ে সেখার শয়তানকে ডেকে পয়গম্বর গেরাদে বাবার আদলে একটি মূর্তি বানাতে বললেন। মূর্তি তৈরি হলে পর ওটা স্থাপন করা হলো মন্দিরে। গেরাদেহ্ রাতদিন মূর্তিটার পুজো করতে লাগল। মূর্তির পায়ের কাছে দিতে লাগল নৈবেদ্য। ঘটনার এখানেই শেষ না। অ্যামোনাইটদের রাজকুমারীকেও বিয়ে করেছিলেন এই পয়গম্বর। তো সেই রাজকুমারী পুজো করত দেবতা মোলকের। মোলক ছিল প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপদেবতা। এই অপদেবতার মাথা ছিল ষাঁড়ের; কাঁধ, হাত আর বুক মানুষের। পেট ভাঁটার চুলোর মত। এর মূর্তি গড়া হত উন্নত ব্রোঞ্জ আর নিরেট লোহা দিয়ে। তাকে তুষ্ট করার জন্যে দেয়া হত শিশুবলি। মূর্তির ভাঁটার মত পেটের ভেতর আগুন জ্বেলে গরম করা হত ওটাকে। আগুনের তাপে মূর্তিটা লাল গনগনে হয়ে উঠলে ওটার সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়া ধাতব হাতের উল্টো করে ধরা তালুর ওপর শুইয়ে দেয়া হত জীবন্ত শিশুকে। দেখতে দেখতে শিশুর ছোট্ট নধর দেহ পুড়ে ঝামা হয়ে যেত। বাইবেলে উল্লেখ আছে, মোলককে অর্ঘ্য নিবেদন করার এমনি কোনও একটা দিনে পয়গম্বর নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু তাঁর অগুনতি স্ত্রী আর রক্ষিতারা নানান মন্দিরে ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর পুজো করত, সেহেতু নিয়মিতই বিভিন্ন মন্দিরে তাঁকে দাওয়াত করা হত। এসব কর্মকাণ্ড ছাড়াও সোলেমান পয়গম্বরের নির্দেশে তাঁর ছেলে জেরোবোমকে হত্যা করা হয়েছিল। সোলেমানকে মুসলমানরা পয়গম্বর মনে করলেও ইহুদি, খ্রিস্টানরা করেন না। তাঁদের মতে সে সময় পয়গম্বর ছিলেন এহিয়া বা ইয়াহিয়া। এই ইয়াহিয়ার সঙ্গে জেরোবোমের খাতির ছিল। এসব নানা কারণে খোদা সোলেমান পয়গম্বরের ওপর রুষ্ট হলেন।
‘আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পয়গম্বর হামামে গেলে এই সেখার পয়গম্বরের রূপ ধরে আমিনার কাছে গিয়ে আংটিটা নিয়ে নেয়। আমিনা বুঝতেই পারেনি আসল সোলেমান পয়গম্বর তখনও বাথরুমে। পয়গম্বর হামাম থেকে ফিরে আমিনার কাছে তাঁর আংটি চাইলে আমিনা আকাশ থেকে পড়ল। সে তো আংটিটা পয়গম্বরকে আগেই দিয়ে ফেলেছে! সোলেমান নবী বুঝে নিলেন, খোদা তাঁর ওপর নাখোশ। রাজপ্রাসাদে তাঁর আর জায়গা নেই। এরই ভেতর পয়গম্বরের রূপও বদলে গেল। চল্লিশ দিন ধরে বন- বাদাড়ে ঘুরতে হয় তাঁকে। সেখার সেই সময় জেরুসালেমের যেসব লোক জাদুবিদ্যা শিখতে আগ্রহী, তাদের সবাইকে ডেকে বলল, সোলেমান পয়গম্বরের সিংহাসনের নিচে লুকানো একটা গহ্বর খুঁড়ে বার করতে। জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ, তার সবই লিখিত আকারে ওখানে রাখা ছিল। ওই লেখাগুলো ছাড়াও অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন আংটির মাধ্যমে খোদা ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে বিষয়ে যেসব নির্দেশনা ফেরেশতাদের দিতেন, সেগুলোও সেখার জেনে ফেলতে লাগল। গোপনীয় সব তন্ত্র-মন্ত্রও নতুন করে বিশদভাবে লেখা হতে লাগল। পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে চল্লিশ দিন পর সোলেমান পয়গম্বর যখন নিজ বেশে প্রাসাদে ফিরলেন, তখন চারদিকে কালো-সাদা সব রকম জাদুর ধুন্ধুমার চলছে। এ যেন ওড়ে খই গোবিন্দায় নমঃ। খোদার দয়ায় সোলেমান পয়গম্বর তাঁর আংটি ফেরত পেলেন এবং কঠোর হাতে গোপন-প্রকাশ্য সব জাদু নিষিদ্ধ করলেন। বিধান দিলেন জাদুর চর্চা যারা করবে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন এ সংক্রান্ত সব পুঁথি- পত্র যেখানে যা ছিল। এরপর তাঁর নির্দেশে আবারও নতুন করে জাদুমন্ত্রের বই লেখা শুরু হলো। আবার এই যন্ত্রণা নতুন করে কেন করতে গেলেন, সেইটে পয়গম্বরই ভাল বলতে পারবেন। যা হোক, সব কিছু লেখা হলে, তাঁর নির্দেশে লোহার একটা বাক্সে বইগুলো ভরে ফের তাঁর সিংহাসনের নিচে গোপন এক খোঁদলের ভেতর রাখা হয়। ধরা হয় তাঁর মৃত্যুর পর যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়, সেই সময় কালো জাদুর চর্চাকারীরা বইগুলো আবারও খোঁদল থেকে বের করে নেয়।
‘কালো জাদু-চর্চার এই হলো শুরু। এরপর আর সেটা থেমে থাকেনি। তবে আগে যা ছিল প্রকাশ্য, এখন তা হয়ে গেল গোপনীয়। পুরনো সভ্যতা যেসব দেশে ছিল, সেগুলোর প্রায় সব জায়গাতেই হারুৎ-মারুতের উল্লেখ আছে। প্রাচীন আর্মেনিয়ায় হরোত-মরোত নামে দুই সহযোগী দেবতা ছিল। পারস্যেও এদের পুজো করা হত। এদের নাম ছিল হরভাত আর আমেরতাত। বহুকাল আগে ফেরাউনের সাম্রাজ্যে প্রধান দুই জাদুকর ছিল জ্যানেস ও জ্যাম্ব্রেস। ধারণা করা হয় মূসা নবীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেধেছিল এদেরই। হারুৎ-মারুই এই জ্যানেস এবং জ্যাম্ব্রেস।’
এতক্ষণ চুপচাপ মৃণাল বাবুর লেকচার শুনে যাচ্ছিল অমল। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত। বাবু কিছুটা পজ দিতেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার জাদু শেখার কী হলো সেইটে তো বললেন না।
‘সে প্রসঙ্গে আসছি। কুকুরের ছবি আঁকতে গিয়ে দেখলাম আমার আঁকার হাত ভাল। বাবা ড্রয়িং মাস্টার রেখে দিলেন। চারুকলার শেষ বর্ষের এক ছাত্র। নাম হিমেল ভট্টাচার্য। এই হিমেলের কাজ ছিল হিন্দু পুরাণে যেসব কাহিনি আছে, সেগুলোর চিত্রায়ণ করা। যেমন রেনেসান্স যুগে ইতালির নামকরা শিল্পীরা বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকত। ছবি আঁকতে হলে যে ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ওটা আঁকা হবে, সেটা খুব ভাল করে জানতে হয়, কিংবা পড়ে নিতে হয়। গুরু যা করে, শিষ্যকেও সেটাই কম-বেশি করতে হয়। হিন্দু পুরাণে বগ্নামুখী নামে এক দেবীর উল্লেখ আছে। এ এক বিচিত্র দেবী। যত ধরনের তন্ত্র-সাধনা আর কালো জাদু আছে, সেগুলোর প্রায় সবটাই এই দেবীর নিয়ন্ত্রণে। এর সব কিছু হলুদ রঙের, এমন কী যে পদ্মফুলের ওপর দেবী অধিষ্ঠিত, সেটাও। পদ্মফুল যে হ্রদে ভাসছে সেই জলও হলুদ। এই কারণে এর নাম হয়েছে পীতাম্বর মা। বগ্লামুখীর আসল নাম বল্লামুখী। সোজা বাংলায় ঘোড়ার লাগাম পরা মুখ। প্রাগৈতিহাসিক কালে শিবের পিঠ থেকে জন্মানোর পর হলুদ সরোবর থেকে উঠে আসে এই দেবী। একবার মহাজাগতিক এক কৃষ্ণ-ঝড়ের কবলে পড়ে ভগবানের সব সৃষ্টি লাটে উঠে যাচ্ছিল। তখন বগ্নামুখী এসে পৃথিবীকে চিরতরে লুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। আলো-আঁধার, শব্দ-নৈঃশব্দ, আধ্যাত্মিক-পৈশাচিক আর ভাল-মন্দের বর্ডার লাইনে এর অবস্থান। তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর ভেতর এর সঙ্গে মিল আছে শুধু মাত্র ছিন্ন-মস্তার। এই ছিন্ন-মস্তা দেবী কালীর দশ রূপের একটা। খুবই রহস্যময় এই ছিন্ন-মস্তা।