‘হারুৎ-মারুৎকে টাওয়ার অভ ব্যাবেলের কাছে নামিয়ে দেয়া হলো। নেমেই তাদের দেখা হলো জহুরা নামে এক যুবতীর সঙ্গে। এই রমণী দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি তার গায়ের সুগন্ধ। স্বচ্ছ মসলিনের ভেতর থেকে রূপ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। দৃষ্টিতে বিদ্যুতের চমক, হাসিতে হীরের দ্যুতি। গায়ের চামড়া ঘিয়ে রঙের মখমল। ঠোঁট জর্ডানি কমলার কোয়া। আলেপ্পোর ডালিম অবতল গাল। পারলে তখুনি যুবতীর রাঙা পায়ে লুটিয়ে পড়ে হারুৎ-মারুৎ। জহুরাকে প্রেম নিবেদন করল তারা। জহুরা দেখল চারে মাছ ভিড়েছে। খেলিয়ে তুলতে হবে। সে বলল, আমাকে পেতে চাইলে আমার আল্লাহকে কুর্নিশ করতে হবে। তার আল্লাহ পাষণ্ড দেবতা মারডক। তবে কুর্নিশ করার আগে মদ খাওয়া জরুরি। যেমন, নামাজ আদায়ের আগে ওজু করা। ওদিকে এসব ব্যাপারে খোদার কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। হারুৎ- মারুৎ ভাবল খোদার বিষয়টা পরে দেখা যাবে। জহুরাকে না পেলে বেঁচে থাকাই সম্ভব না। মদ-টদ খেয়ে মারডককে কুর্নিশ করল হারুৎ-মারু। জহুরা বলল, বেশ, তোমাদের ইচ্ছে পূর্ণ হোক তা হলে। তবে এ মন্দির চত্বরে তো ওসব করা যায় না। শহরের এক কোণে একটা নির্জন বাগান আছে, চলো, সেখানে গিয়ে বাগানের কাছাকাছি যখন তারা পৌঁচেছে, ঠিক তখনহ এক বুড়ো হাবড়া এসে হাজির। ব্যাবিলনের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বুড়ো। ফেরেশতা দু’জনের চোখে-মুখে তালতাল কামনা, অস্থির ভাব, জহুরার চটুল হাসি-এইসব দেখে যা বোঝার বুঝে নিল ভিখিরি। বলল, নগর কোটালের কাছে গিয়ে নালিশ করবে, বলে দেবে সব্বাইকে। ব্যাবিলনের পথে-পথে ব্যভিচার! দেশটার হলো কী!
‘জহুরা তখন আরেক শর্ত দিল।
‘কী?
‘না-এই বুড়ো ভাম শহরে ফেরার আগেই তার মুখ বন্ধ করতে হবে। সব কিছু জানাজানি হলে মান-সম্মান বলে আর থাকবে না কিছুই। রূপের কারণে ব্যাবিলনে জহুরার এন্তার অনুরাগী।
‘হারুৎ-মারুতের মনে পড়ল নরহত্যা করা মানা। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ওটা না করলেও তো চলছে না! দুটো শর্ত যখন ভেঙেই ফেলেছে, আরও একটা ভাঙলেই বা কী? বুড়োকে গলা টিপে মেরে ফেলল তারা। জহুরাকে বলল, প্রিয়ে, নিজেকে সঁপে দাও এখন।
‘কিন্তু এত সহজে ভোলার বান্দি তো জহুরা না। সাত ঘাটের জল সে খেয়ে শেষ করেছে বহু আগেই। বাগানের ভেতর ঢুকে কাপড়-চোপড় খুলে জহুরাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হারুৎ-মারুৎ যখন দাঁত কেলিয়ে হাসছে, তখন জহুরা বলল, শোনো, বন্ধুরা, এত কিছুই যখন করলে, তখন শেষ আরেকটি কাজ আমার জন্যে করো।
‘কী কাজ? না-খোদা তোমাদের প্রতিদিন সন্ধে বেলা সাত আসমানে উঠে যাওয়ার যে গোপন বিদ্যেটা শিখিয়ে দিয়েছেন, সেইটে আমাকে বলে দাও।
‘এই বিদ্যা পৃথিবীর কাউকে শেখানো মানা। হারুৎ-মারুৎ তখন কামনার আগুনে পুড়ে ঝামা ইঁট। তারা ভাবল, এই যুবতী যা চায়, দিয়ে দিই। যেভাবেই হোক একে বিছানায় তুলতে না পারলে আর চলছে না। যাহা বায়ান্ন তাহা তেপান্ন। সাত আসমানে ওঠার গুহ্য বিদ্যা জহুরাকে শিখিয়ে দিল ফেরেশতা দু’জন।
‘বিদ্যা শেখা মাত্র জহুরা উঠে গেল আকাশে। খোদা তাকে শুক্র গ্রহে পরিণত করলেন। ফেরেশতা দু’জন রয়ে গেল ব্যাবিলনের সেই আগাছা ভর্তি রোঁয়া ওঠা বাগানেই। হারুৎ-মারুতের বিচার করলেন খোদা। তাদের সামনে দুটো অপশন রাখলেন। এক, দুনিয়ায় যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন সব রকমের সুখ ভোগ করতে পারবে তারা। তবে মৃত্যুর পর অনন্ত নরকবাস হবে। আর যদি দুনিয়ায় শাস্তি ভোগ করে, তা হলে পরকালে ক্ষমা করে দেয়া হবে তাদের।
‘প্রথমে তারা দুনিয়ার সব সুখ ভোগ করতে চেয়েছিল। পরে দেখবে আখেরাতে কী হয়। তবে এরপর ভেবেচিন্তে মত পাল্টে দুনিয়ায় দেয়া শাস্তি মেনে নেয়। বিচারের পর তারা মানুষকে নিষ্ফল জাদুবিদ্যা শেখাতে লাগল। এভাবে পেরিয়ে গেল কয়েক বছর। এরপর তাদেরকে মাথা নিচে পা ওপরে করে ঝুলিয়ে রাখা হয় প্রথমে টাওয়ার অভ ব্যাবেলের দেয়ালে, পরে টাওয়ার ভেঙে গেলে আসমানে। শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত ওভাবেই ত্রিশঙ্কু হয়ে থাকবে তারা।
‘তবে এটা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক জাদুবিদ্যা চর্চার প্রাথমিক পর্যায়। জাদু অনুশীলনের স্বর্ণযুগ ধরা হয় সোলেমান পয়গম্বরের আমলকে। সোলেমান পয়গম্বরের একটা অতিলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন আংটি ছিল। ওই আংটিতে খোদাই করা ছিল খোদার খুব গোপন এবং পবিত্র একটি নাম। ওটাই ছিল সোলেমান পয়গম্বরের সকল ক্ষমতার উৎস। হামামে গেলে কিংবা রমণী সম্ভোগের সময় আংটিটা হাত থেকে খুলে রাখতেন তিনি। একদিন হামামে যাওয়ার সময় আংটি খুলে চাকরানি আমিনার হাতে দিলেন। শয়তানের অনেক চেলার ভেতর একজনের নাম সেখার। এই সেখারকে দিয়ে সোলেমান নবী একবার একটা মূর্তি বানিয়ে নিয়েছিলেন। মূর্তিটা ছিল সিডনের এক প্রয়াত রাজার হুবহু প্রতিকৃতি। সোলেমান নবী সিডন আক্রমণ করে দখল করার পর সিডনের রাজাকে মেরে তার মেয়ে গেরাদেহ্-কে রক্ষিতা হিসেবে রেখে দেন। বাইবেলের ভাষ্যানুযায়ী এই পয়গম্বরের ছিল সাত শ’ স্ত্রী আর তিন শ’ রক্ষিতা। এইসব স্ত্রী আর রক্ষিতার অনেকেই যে যার বাপ- দাদার দেব-দেবীর পুজো করত। পুজো যাতে ঠিক মত হয়, সেজন্যে সোলেমান পয়গম্বর রাজপ্রাসাদ ঘিরে অনেকগুলো মন্দিরও বানিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও খোদার কাছে শির্ক সবচেয়ে বড় পাপ। পই-পই করে নিষেধ করা হয়েছে মূর্তিপুজো না করার জন্যে।