‘ধারণা সঠিক হয়। সত্যিই জমিদার বাড়ির বাগানে অনেকগুলো আম পাওয়া যায়। সঙ্গে দুটো ঝুড়িও নিয়ে গিয়েছিলাম। দুটো ঝুড়িই ভরে যায়। এত ওজন হয় যে আমার পক্ষে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নেয়া সম্ভব নয়। মাথায় বুদ্ধি আসে, জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরটার মাঝে লুকিয়ে রেখে গেলে কেমন হয়। সকালে ধলু কাকুকে পাঠিয়ে আনাব। ধলু কাকু হচ্ছেন আমাদের বাড়ির কামলা। দাদার আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে কামলার কাজ করতেন। আমি কিছু বললে তিনি না করবেন না। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আর বাবাকেও জানাবেন না যে, আমি রাতে চুপি-চুপি আম কুড়াতে এসেছিলাম।
‘জমিদার বাড়ির চিহ্ন বলতে একমাত্র ওই কাছারি ঘরটাই ছিল। তা-ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে কোনও মতে কাঠামোটা দাঁড়িয়ে ছিল। ভিতরে রাজ্যের নোংরা। মাকড়সার ঝুল, ইঁদুর-তেলাপোকার নাদ, বাদুড়ের বিষ্ঠা, উড়ে আসা শুকনো পাতা, এমনকী দিনের বেলায় আশ্রয় নেয়া গরু-ছাগলের মলও রয়েছে।
‘ঝুড়ি দুটোকে টেনে-হিঁচড়ে কোনওক্রমে কাছারি ঘরের দিকে নিয়ে যাই। যেই না প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকতে গেলাম ভয়ানক চমকে উঠি। ভিতরে কারা যেন রয়েছে! গম-গম শব্দ হচ্ছে। প্রবেশদ্বারের পাশে নিজেকে আড়াল করে ভিতরে দেখার জন্য উঁকি মারি। কী আশ্চর্য! ভিতরে তিনজন মানুষ। মানুষ বললে ভুল হবে, তারা মানুষ নয়-অন্য কিছু। অনেক লম্বা। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা হাত- পা। পিছনে হনুমানের মত লম্বা লেজ। মুখমণ্ডলও হনুমানের মুখের মত লম্বাটে। চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বলে। সমস্ত গা থেকে সবুজাভ দ্যুতি বেরোচ্ছে।
‘প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে আঁতকে উঠে ‘ও, মা’ বলে চিৎকার দিয়ে ফেলি। আমার মুখ থেকে চিৎকারটা বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে ওই তিনজন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতে আমার আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এক মুহূর্তও দেরি না করে হাত থেকে আমের ঝুড়ি ফেলে ঘুরে দৌড় লাগাই। রুদ্ধশ্বাসে পড়িমরি করে দৌড়তেই থাকি। কিন্তু জমিদার বাড়ির সীমানা পেরোবার আগেই কী যেন হয়। স্পষ্ট মনে নেই। এটুকুই মনে আছে চোখ ধাঁধানো নীলচে আলোর তীব্র ঝলকানি দেখতে পাই। যেন সেই আলোর ঝলকানিতে চোখ দুটো ঝলসে যায়। সেই সঙ্গে কান ফাটানো বিকট ভয়ানক শব্দ। কানে তালা লেগে যায়। নিমিষে সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলি।’
ইয়াসমিন বেগমের বলা থামতেই সুলতানা বেগম অত্যন্ত আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর, তারপর কী হলো? আপনার ওপর কি বজ্রপাত হয়েছিল?’
ইয়াসমিন বেগম আবার বলতে লাগলেন, ‘হতে পারে। গায়ে বজ্রপাত হওয়ার কী অনুভূতি তা তো আমার জানা নেই। যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে পাই আমার শোবার ঘরের বিছানায়। মা আমার কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। আমাকে ঘিরে রয়েছে আত্মীয়-স্বজন সহ আশপাশের প্রতিবেশীরা অনেকেই।
‘চোখ মেলতেই সবাই কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করতে থাকে, কী হয়েছিল আমার? আমি ওই জমিদার বাড়িতে কখন গিয়েছিলাম? জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরের মধ্যে কী কাজ ছিল? কী ঘটেছিল ওখানে? ওখানে এত রক্ত এল কোত্থেকে?
‘আমি সব কিছু বললাম। মানে, আম কুড়াতে গিয়ে যা- যা ঘটেছিল সব।
‘অনেকে দেখলাম ভয় পেয়ে বুকে থু-থু দিল। সবাই বলাবলি করতে শুরু করল, জিনের খপ্পরে পড়েছিলাম আমি। কপাল ভাল বলে বেঁচে ফিরতে পেরেছি।
‘একজন চোখ বড় করে বলে উঠল, জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরের মেঝেতে এত রক্ত এল কোত্থেকে? যেন ওখানে গরু জবাই দেয়া হয়েছে! অথচ ইয়াসমিনের গায়ে কোনও কাটা ক্ষত নেই। তা হলে ওই রক্ত কার? জিনের রক্ত না তো?
‘কেউ-কেউ আমাকে শাসাতে শুরু করল, কতবার বারণ করা হয়েছে, রাত-বিরাতে যেন আম কুড়াতে না যায়। শুনল না, কোনও কথা শুনল না। শেষ পর্যন্ত জিনের কবলে পড়ল! কপাল ভাল যে বেঁচে ফিরেছে…
‘উপস্থিত সবাই যে যার মত কথাবার্তা বলতে থাকে। আর মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কেঁদে-কেটে ব্যাকুল হয়।’
সুলতানা বেগম বলে উঠলেন, ‘কাছারি ঘরের ভিতরে গরু জবাই দেবার মত রক্ত পড়ে ছিল মানে?’
ইয়াসমিন বেগম বলতে লাগলেন, ‘আমি তো আর দেখিনি, সবার কাছে যা শুনেছি। সেদিন ভোর বেলা আমাকে ঘরে না দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। সারা গ্রামে খোঁজা হয়। শেষতক জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত কাছারি ঘরের ভিতরে গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে পড়ে থাকতে দেখে। পোশাকবিহীন-উলঙ্গ। আমার সারা গায়ে রক্ত মাখা। যেখানটায় পড়ে ছিলাম পুরো জায়গা গরু জবাই দেবার মত রক্তে ভেজা। অথচ আমার গায়ে কোনও কাটা ক্ষত ছিল না। তাই ওই রক্ত কোত্থেকে এসেছে, কীসের রক্ত-সেটা সবার কাছে ভয়ানক রহস্যময় বলে মনে হয়।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘সেদিন ঝড়-বৃষ্টির রাতে আম কুড়াতে গিয়ে অমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন বলেই কি আপনার এখন আর ঝড়-বৃষ্টি ভাল লাগে না?
‘সেটা তো আছেই, তার সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে। ওই রাতের ঘটনা ওখানেই শেষ হলে তো আর কোনও কথাই ছিল না। ওই ঘটনার পর আমার জীবনটাই বদলে যায়। আমার চেহারা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সব কিছু বদলে যায়। যেন আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই। আমার চেহারায় পুরুষালী ছাপ আসে। মাথা যন্ত্রণার রোগ দেখা দেয়। প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা! যার কি না আগে মাথা ব্যথা জাতীয় কোনও রোগই ছিল না। যন্ত্রণাটা সব সময় নয়, শুধু ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই। ব্যথার তীব্রতা এতই হয় যে আমি পাগলের মত আচরণ করি। উদ্ভট, উল্টো-পাল্টা কথা বলি। যে কথার মানে কেউ-ই বোঝে না। নিজের পরিচয় পর্যন্ত ভুলে যাই। আপনজনদেরও চিনতে পারি না। গলার স্বরও পরিবর্তন হয়ে পুরুষালী হয়ে যায়। নিজেকে নাকি তখন অন্য মানুষ বলে দাবি করি। অবশ্য ওই সময়ের কোনও কিছুই আমার পরবর্তীতে মনে থাকে না। অন্যের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছি। এ কারণেই ঝড়-বৃষ্টি আসতে দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।