‘বাবা দুর্গের মত নিশ্ছিদ্র করলেন বাড়ির নিরাপত্তা। এখন যে দারোয়ান আছে, তাকে অবশ্য আমি নেপাল থেকেই এনেছি। আগের জন মারা গেছে। আমার মন ভাল করার জন্যে সুন্দর সুন্দর সব ছবিঅলা বই কিনে দিলেন বাবা। প্রথম দিকে পড়তে ভাল লাগত না। নেড়েচেড়ে রেখে দিতাম। তবে অবস্থার পরিবর্তন হলো। আস্তে আস্তে পৃষ্ঠা উল্টে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। প্রায় সবই রূপকথার বই। এর ভেতর আলিফ লায়লার গল্পের বইও ছিল। যা হোক, একদিন জাপানি রূপকথার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ করেই ‘হানা সাকা জিজি’ বলে একটা গল্প চোখে পড়ল। ‘শিরো’ নামের এক কুকুর, তার করুণ মৃত্যু আর প্রভুভক্তি নিয়ে লেখা অপূর্ব এক কাহিনি। জাপানি ভাষায় শিরো মানে বরফের মত সাদা। কুকুরটা তুষার-শুভ্র হওয়াতেই তার ওই নাম। কাহিনিটার ভেতর আবার এক- দুই লাইনের গানও আছে। দুর্দান্ত গানের কথা। অভিভূত হয়ে গেলাম গল্পটা পড়ে। এরপর জন্তু-জানোয়ার নিয়ে লেখা যত রূপকথা আছে পড়তে লাগলাম সেই সব। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসেনের টিণ্ডার বক্স গল্পের সেই সাহসী সৈনিক আর তিন ভয়ঙ্কর কুকুরের কাহিনি। জার্মানির রূপকথার ভেড়ার বিনিময়ে পাওয়া তিনটি কুকুর, যাদের নাম ছিল লবণ, মরিচ আর সরষে বাটা। গ্রিক মিথলজির
মৃতদের রাজ্যের গেট পাহারা দেয়া তিন মাথাঅলা অপরাজেয় কুকুর সারবারস। মোদ্দা কথায়, কুকুর নিয়ে লেখা কাহিনি যা আছে, প্রায় সবই পড়ে ফেললাম। এবং সেগুলো বিশ্বাসও করতে লাগলাম। সব শেষে পড়া শুরু করলাম আলিফ লায়লা। এর নাম হাজার এক আরব্য রজনী। কাহিনির পর কাহিনি। কৃষ্ণ জাদু বা ব্ল্যাক আর্টের ছড়াছড়ি। দেদারসে মানুষ, থেকে কুকুরে আর কুকুর থেকে মানুষে রূপান্তর হচ্ছে। তারপর সেই সব কুকুরদের নিয়ে অদ্ভুত কাহিনি। ডাইনী আমিনার খপ্পরে পড়ে সিদি নোমানের কুকুর হওয়া আর তার পরের কর্মকাণ্ড পড়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। বাগদাদের তিন রমণী আর কুলির কাহিনি আর দ্বিতীয় শেখের গল্পের কথা না-ই বা বললাম।
‘খুব শিগগিরই বুঝতে পারলাম, বই পড়ার আগ্রহ কুকুর দিয়ে শুরু হলেও এখন সেটা আর কুকুরে সীমাবদ্ধ নেই। এখন আমার সব আগ্রহ জাদুমন্ত্রে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, জাদুমন্ত্র দিয়ে দিনকে রাত, রাতকে দিন করা সম্ভব। বয়স কম, অনভিজ্ঞ কচি মন। যা পড়তাম, তা-ই বিশ্বাস হত। ব্যাপারটা অনেকখানি স্যান্টা ক্লজে বিশ্বাস করার মত। আলিফ লায়লার আধিভৌতিক জগৎ আমাকে বলতে গেলে মেসমেরাইজ করে ফেলল। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, জীবিত মানুষকে পাথরের রূপ দেয়া সম্ভব কিংবা পাথরের মূর্তিতেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেমন আলিফ লায়লার জেলে ও দৈত্যের কাহিনির পাথর- রাজকুমার। মনে হলো আমার দরকার শুধু সঠিক জাদুমন্ত্রের। কিন্তু জাদুমন্ত্রের শিক্ষা শহরের বিদ্যানিকেতনগুলোতে দেয়া হয় না। আসলে কোনও বিদ্যানিকেতনেই দেয়া হয় না। এ হলো গোপন বিদ্যা। এর গুহ্যতত্ত্ব শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকজনের ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকে। এ বিদ্যা গুরু ধরে শিখতে হয়। সেই গুরু খুঁজে পাওয়াও ভীষণ কঠিন। সব জাদুবিদ্যার মূলেই কাজ করে ঐশ্বরিক শক্তি। তবে এই শক্তি ঐশ্বরিক হলেও ওটা আসে প্রিন্স অভ ডার্কনেসের কাছ থেকে। ঈশ্বর এর দায়-দায়িত্ব নেন না। আলিফ লায়লাতে যেসব জাদুকরীদের কথা বলা হয়েছে, তাদের অনেকেই মহান আল্লাহকে স্মরণ করেই ব্ল্যাক আর্ট প্র্যাকটিস করে। কারণ সব শক্তির আধার ঈশ্বর স্বয়ং। অনেক ধর্মেই উল্লেখ আছে, জাদুমন্ত্র এসেছে দেবদূত কিংবা ফেরেশতাদের কাছ থেকে। মন্ত্রবলে অতিলৌকিক কর্মকাণ্ড দুনিয়ার বুকে তারাই প্রথম শুরু করে। হারুৎ- মারুতের কথা কে না জানে। সূরা আল বাকারাতে বলা হয়েছে, হারুৎ-মারুৎ দুনিয়ায় যেসব লোক জাদু শিখতে আগ্রহী ছিল, তাদের হাতেকলমে জাদু শিক্ষা দিত, এইটে প্রচার করার জন্যে যে, এসব শিখে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। এই দুই ফেরেশতাকে পাঠানো হয়েছিল হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর আমলে ব্যাবিলন নগরীতে।
‘ব্যাবিলনে তখন নমরুদের রাজত্ব চলছে। টাওয়ার অভ ব্যাবেল তৈরির জন্যে রাতদিন খেটে মরছে লক্ষাধিক শ্রমিক। একই সঙ্গে এনলিল, ইশথার, মারডক আর শামাশের পুজোয় চারদিকে ধুন্ধুমার। এটেমেনানকি যিগুরাটে চলছে সকাল-সন্ধ্যা এন্তার নরবলি-পশুবলি। নমরুদের রাজত্বে যে যত বড় জাদুকর, সে তত বেশি ক্ষমতাশালী। কামিনী-কাঞ্চন তার দোরগোড়ায় গড়াগড়ি খাচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টা। হাজার হাজার টাকমাথা পুরোহিত অনন্ত নক্ষত্রবীথি ছানাছানি করে বের করার চেষ্টা করছে জাদুমন্ত্রের সঠিক তিথি। আসল খোদার কথা কারও মনেও নেই। এসব দেখে ফেরেশতারা খোদার কাছে অনুযোগ করল। তারা খোদাকে বলল, এই মানব জাতি নেমকহারাম। এরা মহান করুণাময়ের ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। এদেরকে অবিলম্বে শেষ করে দেয়া হোক। খোদা এরই ভেতর মহা প্লাবন পাঠিয়ে নূহ নবীর কওম সহ পৃথিবীর তাবৎ মানুষজন আর পশুপাখি মেরে দুনিয়াকে গড়ের মাঠ বানিয়েছেন। চাইলেই গজব নাজিল করা সম্ভব না। তা করলে ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতেই সময় শেষ। মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। খোদা বললেন, মানুষের ভেতর লোভ, মোহ, কাম এইসব আছে। তোমাদের ভেতর নেই। থাকলে তোমরাও অমনটাই করতে। ফেরেশতারা এই কথা শুনে তাদের ভেতর সব থেকে ভাল দু’জনকে বেছে বের করল। হারুৎ আর মারুৎ। খোদার গুণগান তাদের থেকে ভাল কেউ করতে পারেনি। খোদাকে ফেরেশতারা বলল, মানুষের দোষ-ত্রুটি দিয়ে এদেরকে দুনিয়ায় পাঠান। পরীক্ষা হয়ে যাক, মানুষ ভাল না ফেরেশতা বেশি ভাল। যা হোক, খোদা এই দু’জনকে লোভ, মোহ, কামনা, বাসনা এসব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠালেন। পই-পই করে বলে দিলেন চারটি জিনিস কিছুতেই করা যাবে না। শিরক, ব্যভিচার, মদ্যপান আর নরহত্যা।