‘হোটেলে নিয়ে যদি ভাতই খাওয়াবেন, তা হলে বাদাম খাইয়ে খিদেটা নষ্ট করলেন কেন? আচ্ছা, ধরেন খাওয়ালেন। তারপর কী করবেন?’
‘জানি না কী করব। ভাত খেতে চাইলে চলো।’
‘আপনি পারবেন না। বাদ দেন এসব দরদ-ফরদ। আপনি আসলে ভাবছেন আরও কিছুটা সময় পার করলে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ওভাবে হয় না। তার চেয়ে বরং বাসায় যান। রেস্ট নেন। ব্যাটা-ঘাঁটা আমাদের ব্যবসা। কে কী পারবে এইটা ঠিকই বুঝি।’
অর্ধেক বাদাম বেঞ্চের ওপর ফেলে রেখেই উঠে পড়ল মেয়েটা। একবারও পেছন দিকে না তাকিয়ে চলে গেল পার্কের বাইরে। বিকেলের মরা আলোয় অমল তার চলে যাওয়া দেখল। কী বিষণ্ণ হাঁটার ভঙ্গি! এসব মেয়েদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। যতদিন দেহে রস-কষ আছে, ইনকাম আছে। এরপর অসুখ-বিসুখে পঙ্গু হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে খাও। তারপর ড্রেনের পাশে কাপড়েই পেশাব-পায়খানা করে চোখ উল্টে মরো। চলে যাও আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের জিম্মায়। তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়!
আট
পরদিন ঠিক সকাল দশটায় তার ‘অফিসে’ পৌঁছাল অমল। গুর্খা দারোয়ান সরাসরি তাকে নিয়ে গেল আগন্তুকের কাছে। লিভিং রুমে আগের মতই পুরনো বই খুলে বসে আছে সে। অমলের শুভেচ্ছা-গুডমর্নিং এসব গ্রহণ করে তাকে বসতে বলল আগন্তুক। ট্রলিতে করে কফির সরঞ্জাম সাজিয়ে এনে দুটো কাপে কফি পরিবেশন করল একজন উর্দিপরা খানসামা। আগন্তুক বলল, ‘কফি খান, অমল বাবু। কফি খেতে খেতে আপনার কাজ বুঝিয়ে দিই। আপনার কাজ বুঝিয়ে দেয়ার আগে ছোট্ট একটা ভূমিকা প্রয়োজন। ব্যাকগ্রাউণ্ড ইনফর্মেশন ছাড়া বিষয়টা পুরো বুঝতে পারবেন না। আমার নাম দিয়েই শুরু করি। আমার নাম মৃণাল কান্তি। আমার ঠাকুরদা কর্কট কান্তির রাজশাহী এলাকায় জমিদারি ছিল। ছোটখাট জমিদার। তবে সেরিকালচার অর্থাৎ রেশমের ব্যবসা করে অঢেল পয়সা বানিয়েছিলেন। পয়সা বানালেও দাদা ছিলেন সাত্ত্বিক ধরনের লোক। তাঁর জীবন-যাপন ছিল খুব সাধারণ। বাইজী নাচিয়ে কিংবা মদ খেয়ে জুয়া খেলে পয়সা উড়াননি কখনও। বাবাকে মানুষ করেছিলেন কড়া শাসনে। আমার বাবা কৃষ্ণ কান্তি ছিলেন ব্যারিস্টার। খুব নামকরা কেউ না। তবে আয়-ইনকাম খারাপ ছিল না। কোলকাতায় আমাদের বেশ কয়েকটা বাড়ি আর দোকান ছিল। এক খুড়ো দেখাশোনা করতেন। সেখান থেকে বড় অঙ্কের মাসোহারা আসত। জমিদারি বিলুপ্ত হলেও রাজশাহী শহরের প্রপার্টিও রেভেনিউও কম ছিল না। আমার নানার অবস্থাও ছিল বিরাট। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আরাম-আয়েশের কোনও ব্যত্যয় কখনও হয়নি। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমার মামা আমাকে একটা ইংলিশ রিট্রিভার কিনে দেন। কুকুর হিসেবে রিট্রিভার দারুণ ফ্রেগুলি। ইংরেজদের কুকুর, বুদ্ধির কথা আর কী বলব। শিকারী কুকুর হিসেবে এদের তুলনা নেই। ধবধবে সাদা রঙ, ইয়া মোটা লেজ, বড়-বড় ভাঙা কান মুখের দু’পাশে লটপট করছে। কুচকুচে কালো নাক আর চোখ। সারা গায়ে তুষারের মত নরম ঝুমকো পশম। ন’বছর বয়স পর্যন্ত কুকুরটা ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। শুধু রাতে শোয়ার সময়ই ওটা আমার কাছ থেকে আলাদা হত। আমার জন্মের তিন বছর পর আমার মায়ের গর্ভপাত হয়। এরপর থেকে প্রায় সবসময় অসুস্থই থাকতেন মা। কুকুরটা ছিল আমার বন্ধু, খেলার সাথী-সব কিছু।
‘তখন আমাদের বাড়ি ছিল পুরান ঢাকায়। ন’বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে শুরু হলো পাক-ভারত যুদ্ধ। আমাদের দিন কাটতে লাগল আতঙ্কের ভেতর। প্রহ্লাদ মানে আমার রিট্রিভার সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিত। আসলে বাউণ্ডারি ওয়ালের ভেতর ঘোরাঘুরি করত। সেই সময়ে একদিন সকালে উঠে দেখি গাড়ি বারান্দার সিঁড়ির ওপর মরে পড়ে আছে প্রহ্লাদ। মুখ দিয়ে গাঁজলা-টাজলা বেরিয়ে একাকার। পাড়ার কেউ তাকে বিষ খাইয়েছিল। গাড়ি বারান্দা থেকে বাড়িতে ঢোকার মূল দরজায় আঁচড়ের দাগ। মারা যাওয়ার আগে প্রহ্লাদ হয়তো আমার কাছে যেতে চেয়েছিল। বাড়িতে বিহারী দারোয়ান ছিল। তারপরেও এই ঘটনা কীভাবে ঘটল বোঝা গেল না। আমার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল। রাতদিন প্রহ্লাদের কথা মনে পড়ে। নাওয়া- খাওয়া ভুলে গাড়ি বারান্দার সিঁড়ির কাছে বসে থাকতে লাগলাম আমি। ছোট বেলা থেকেই আমার আঁকাআঁকির হাত ভাল। আমার কাজ হলো বসে বসে প্রহ্লাদের ছবি আঁকা। বাচ্চারা খুব দ্রুত শোক কাটিয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতিই তাদের সেই শক্তি দিয়েছে। কিন্তু আমার ভেতর শোক কাটিয়ে ওঠার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়তে লাগলাম। শেষমেশ পড়ে গেলাম বিছানায়। শুধু মনে হত এই বুঝি প্রহ্লাদ ফিরে এল। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখতাম, ফিরে এসেছে প্রহ্লাদ। কিন্তু সেটা শুধু স্বপ্নই। বাস্তবে ফাঁকা বাড়ি। শূন্য বাড়ির আঙিনার একপাশে প্রহ্লাদের কাঠের ছোট্ট ঘরটা। প্রহ্লাদের ঘরের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর জলহীন কাঠের বারকোশ। ঈশ্বরকে বলতাম, হে, ভগবান, ফিরিয়ে দিন আমার প্রহ্লাদকে। আপনি তো সব পারেন। কিন্তু প্রহ্লাদ আর এল না। আমার মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে ভেবে বাড়ি বেচে দিলেন বাবা। উঠে এলেন ধানমণ্ডির এই বাড়িতে। কুষ্টিয়া থেকে নেপালি দারোয়ান আনলেন। কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলে তখন প্রচুর নেপালি দারোয়ান ছিল। মোহিনী বাবুই ব্রিটিশ আমলে নেপাল থেকে এই গুর্খা দারোয়ানদের এনেছিলেন। মোহিনী বাবুর ভাই কানু বাবুর সঙ্গে বাবার খুব খাতির ছিল। পাকিস্তান সরকার মোহিনী মিলকে তখন রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। অনেকেরই চাকরি চলে যায় এ কারণে।