সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে অমল সিদ্ধান্ত নিল, কথা বলবে মেয়েটার সঙ্গে। বারবণিতার সঙ্গে বাক্যালাপ করাও এক বিরল অভিজ্ঞতা। এ সুযোগ প্রতিদিন ঘটে না। খুকুর- খুকুর কেশে গলা-টলা পরিষ্কার করল অমল। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করছে। পুরুষ ঘেঁটে ঘেঁটে মেয়েটাও ঝানু হয়ে গেছে। সে-ও কাশি শুনে বুঝতে পারল, চারের আশপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে মাছ। টোপ খেলেও খেতে পারে। মুচকি হেসে অমলের দিকে তাকাল মেয়েটা। তবে কথা কীভাবে শুরু করবে, এইটে বুঝতে পারছে না অমল। এ লাইনে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। মুচকি হাসির জবাবে অমলও হালকা হাসি হাসল। কিছু একটা বলতে হবে। কিন্তু কী বলবে! ‘এই মেয়ে, তোমার নাম কী?’ উঁহুঁ, এভাবে হবে না। ওটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশের জন্যে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণত যা বলা হয় তা হলো: ‘এই, তোর রেট কত?’ অথবা শুধুই ‘রেট কত?’ বাক্যের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে বারবণিতার স্ট্যাণ্ডার্ডের ওপর। অমলের চোখে পড়ল সামনে দিয়ে এক চাঅলা যাচ্ছে। বাতচিত শুরু করার এই এক মওকা। চাঅলাকে ডেকে দু’কাপ চা দিতে বলল অমল। এরপর তাকাল মেয়েটার দিকে।
এইবার কথা বলল মেয়েটা, ‘আমার চা লাগবে না। আপনিই খান।’
‘আরে, খাও না এক কাপ।’
‘আচ্ছা, দেন।’
‘নাম কী তোমার?’
‘আমার নাম রেখা।’
অবশ্যই আসল নাম না। বারবণিতাদের প্রায় সবার নামই চিত্রনায়িকাদের নামে হয়। এ-ও একধরনের ফ্যান্টাসি। পুরুষদের সঙ্গিনী খেঁদি-কুঁচি না হয়ে জুহি-মাধুরী- রাভিনা-ঐশ্বরিয়া হলে সেটাই সবিশেষ গ্রহণযোগ্য। স্বপ্নেই যখন খাব, তখন বুন্দিয়া-হালুয়া বাদ দিয়ে চমচমই খাই-মনে মনে ভাবল অমল। তবে মুখে বলল, ‘বাহ্, সুন্দর নাম। এই নামের বিশেষত্ব কী, জানো?’
‘কী?’
‘এই নাম থেকে হিন্দু-মুসলমান বোঝা যায় না।’
‘হিন্দু-মুসলমান নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? আপনি তো হুজুর না। আপনি আসলে হিন্দু। ঠিক না?’
থতমত খেয়ে গেল অমল। কথার পিঠে কথা বলতে মেয়েরা ওস্তাদ, একথা ঠিক। তবে এ মেয়ের বেশ বুদ্ধি আছে বলেই মনে হলো তার কাছে। বলল, ‘বাদ দাও এসব। তুমি থাকো কোথায়?’
‘কোথাও না।’
‘কোথাও না মানে কী?’
কোথাও না মানে, কোথাও না। আমি থাকি রাস্তায়।’
‘কোন্ রাস্তায়?’
‘পিচ ঢালা রাস্তায়। হি-হি-হি।’
‘হাসছ কেন তুমি? রাস্তায় থাকা খুব আনন্দের বিষয় না।’
‘আপনি থাকেন কোথায়? হি-হি-হি।’
‘আমি থাকি কোথায় মানে?’
‘আপনি থাকেন কোথায় মানে, আপনি কোথায় থাকেন। খালি মানে জানতে চান কেন? বাংলা ভাষা বোঝেন না?’
অমলকে রেগে যেতে দেখে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল মেয়েটা। হাসির দমকে কাপ থেকে চা ছলকে পড়ে গেল। মুখের কাছে বাঁ হাত এনে মুখ ঢাকার চেষ্টা করল সে। তারপরেও কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ হেসে চোখের জলটল মুছে চুমুক দিল চায়ে। বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আপনি ভাল মানুষ। একটু মজা করলাম। এর বেশি কিছু না।’
অমল জানে বাজারে-মেয়েগুলোর পুরুষদের ওপর কোনও শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এরা পুরুষদের চোখে শুধু তাল তাল কামনাই দেখতে পায়। পুরুষ মানেই এদের কাছে কাপড় তোলা, মর্দিত হওয়া আর তাদের জঘন্য অশ্লীল কথাবার্তা কান খুলে শোনা। পুরুষেরা বাস্তবে এদের সঙ্গে মিলিত হলেও তাদের কল্পনায় থাকে এদের মায়েরা। মর্দিত হতে হতে এরা শুনতে পায়: চোপ, শালী, তোর মায়েরে… তাদের মাদের সঙ্গে এহেন কাল্পনিক আচরণের সরাসরি বহিঃপ্রকাশে অবশ্য ঝানু বারবণিতারা মোটেও চুপ করে থাকে না। কিংবা কুপিত হয়ে পুরুষদের বিচ্যুতও করে না। উল্টো তারা বিদ্ধ করার কাজে আরও উৎসাহ দেয়। উড়াও কল্পনার ফানুস, ঝরাও কামনা! যেমন বহুকাল আগে ঠগিদের সর্দার কোনও নিরীহ পথিককে ভর পেট খাইয়ে-দাইয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার আগে তার চেলাদের চিৎকার করে বলত: ঝরকা উঠাও, উঠাও ঝরকা। ওটাই মৃত্যু সঙ্কেত।
অমলকে চুপ করে থাকতে দেখে মেয়েটি বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেন, ভাই। আমরা পথের মানুষ। আমাদের কথা ধরতে নেই।’
‘আরে না, কী যে বলো! রাগ করব কেন? আমরা সবাই তো পথের মানুষ। জীবনটাই একটা যাত্রা। আমরা সবাই যাত্রী একই তরণীর। এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি। একদিন সময় সমাপ্ত। বেজে গেল বিদায় ঘণ্টা। শুরু হলো ওপারের যাত্রা। …তারপর বলো, দুপুরে কী খেয়েছ?’
‘দুপুরে ঝালমুড়ি খেয়েছি। আপনি কী খেয়েছেন?’
‘আমার কথা বাদ দাও। এসো, তার চেয়ে বাদাম কিনে খাই। এই, বাদামঅলা, দু’ শ’ বাদাম দাও তো। এক শত এক শ’। নুন ঝাল বেশি করে দাও। দুটো কাগজে আলাদা করে দিবা।’
মুটমুট করে বাদামের খোসা ভেঙে হাতের তালুতে ঘষে লাল ছিলকা ছাড়িয়ে তারপর ফুঁ দিয়ে ছিলকা উড়িয়ে কুটকুট করে বাদাম খেতে লাগল মেয়েটা। হুমায়ূন আহমেদের হিমুর গল্পে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বারবণিতারা যেভাবে বাদাম খায়, ঠিক সেভাবে। তরুণী মেয়েদের বাদাম খাওয়া দেখতে চমৎকার ভাবল অমল। কিন্তু এরপর কী? গল্পের নায়কেরা বারবণিতাদের সঙ্গে শুধু কথা বলে, অন্য কিছু করে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেয়েগুলোর দুঃখ-কষ্টে হিমু উহ্-আহ্ করলেও ওদের কাছ থেকে নিজেকে শত হাত দূরে রেখেছে। দেবদাস চন্দ্রমুখীর গান শুনে, নাচ দেখে আর বোতল-বোতল মদ খেয়ে লিভার পচানো ছাড়া এক্সট্রা কোনও কিছু করেনি। বাজারে-মেয়েছেলেদের দারুণভাবে পছন্দ করলেও তাদের আসল সার্ভিস এরা খুব কেয়ারফুলি এড়িয়ে গেছে। সার্ভিস গ্রহণ করলে পাঠকদের কাছে পতন অনিবার্য হয়ে উঠত। সব সমবেদনা উবে যেত হাডে অক্টেনের মত। পাঠকেরা নিজেরা যা পারে না, নায়ককে তা অবশ্যই পারতে হবে। শুরুর দিকে নায়ক চরিত্রহীন হলেও পরের দিকে তাকে হতে হবে সাধু পুরুষ। একই রকম থাকা চলবে না। চললে সিনেমা ফ্লপ হবে, বই মার খাবে। আর নায়িকারা বাইজী হলেও তারা শুধু নাচ-গান পরিবেশন করবে, ‘আসল সার্ভিস’ অবশ্যই না। যদিও প্র্যাকটিক্যালি সেটা অসম্ভব। নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দর্শক-পাঠকও যে সেটা বোঝে না, তা নয়। তবুও তারা ‘নাচ-গানের বাইরে কিছুই হয়নি’-তে বিশ্বাস করতে চায়। যেটাকে বলে উইলিং সাসপেনশন অভ ডিসবিলিফ। এসব ভাবতে ভাবতে অমল মেয়েটাকে বলল, ‘চলো যাই। হোটেলে গিয়ে ভাত খাই বরং।’