সোফায় বসে আদ্যিকালের একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল সফেদ আগন্তুক। বই না বলে বাঁধানো পাণ্ডুলিপি বলাই ভাল। চোখের ইশারায় অমলকে বসতে বলল সে। এই প্রথম কালো চশমা ছাড়া আগন্তুককে দেখল অমল। অনেকেই বলে মানুষের চোখ বাঙ্ময়। চোখ যে মনের কথা বলে। এ লোকের চোখ পাথরের। মনের ভাবনা-চিন্তার কোনও ছাপ সেখানে নেই। অসম্ভব প্রাণহীন আর পুরোপুরি নির্লিপ্ত। তার ওপর আবার চোখের পাতার অর্ধেকটা নেই বললেই চলে। কীসে যেন খেয়ে ফেলেছে ওগুলো। কৃষ্ণ সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে আগন্তুক বলল, ‘ঠিক আছে, মন্দাকিনী, তুমি এখন যাও।’ ফাইলটা অমলের হাতে দিে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীক। ‘ফাই খোলেন, অমল বাবু,’ আবার কথা বলল আগন্তুক। ‘ওখানে ফর্ম আছে। ফর্মগুলো পূরণ করেন। ফর্মগুলোর নিচে চাকরির কন্ট্রাক্ট। ভাল করে শর্তগুলো পড়ে সই করবেন। শর্ত ভঙ্গ করা যাবে না কিছুতেই।’
ফর্ম পূরণ করতে লাগল অমল। ফর্মের ডিটেল অত্যধিক বেশি। চোদ্দ গুষ্ঠির ঠিকুজি-কুলজি চেয়ে বসে আছে। সারাজীবনে কোথায় কী করেছে তার প্রায় পুরোটাই লিখতে হলো। সেই সঙ্গে পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানা আর চারজন আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ নয় এমন লোকের ফোন নম্বর। ভাগ্য ভাল, যারা ইন্সুরেন্স পলিসি কিনেছিল, তাদের ফোন নম্বরগুলো পকেট ডাইরিতে লেখা ছিল। ফর্ম পূরণ করা শেষ হলে বেরুল কন্ট্রাক্টের কাগজ। প্রথম শর্ত যেটা মোটা কালিতে লেখা আছে, সেটি হলো: অফিসের কোনও কথা কোনও অবস্থাতেই বাইরে বলা যাবে না। কাউকে না। এই শর্ত ভঙ্গ হলে চাকরি তো যাবেই, সেই সঙ্গে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার কোম্পানির থাকবে।
‘কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ কী তা অবশ্য বলা নেই। এবং সমস্যাটা ওখানেই। সম্ভবত শাস্তিমূলক ব্যবস্থাটা হবে খুবই সূক্ষ্ম এবং সারাজীবন যাতে ভুগতে হয়, সেই রকমের কিছু একটা। শর্তের শেষের দুটো ক্লজে লেখা, সপ্তাহে কয়দিন কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, ছুটি-ছাটা, আর বেতনের কথা। প্রতি সপ্তাহে সাড়ে সাত হাজার টাকা বেতন। অর্থাৎ মাসে ত্রিশ হাজার। এ তো দেখি গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। ত্রিশ হাজার টাকা ছাব্বিশ দিনের মাইনে! খসখস করে সই করে তারিখ বসিয়ে দিল অমল। এরপর কাগজ থেকে মুখ তুলে চাইল আগন্তুকের দিকে। পাণ্ডুলিপির ভেতর ডুবে আছে আগন্তুক। তারপরেও অমল চেয়ে আছে এইটে কীভাবে যেন টের পেল লোকটা। তাকাল অমলের দিকে। জিজ্ঞেস করল, ‘রেডি?’
‘জী। ফরম পূরণ করা শেষ। জব কন্ট্রাক্টে সই করাও হয়ে গেছে।’
‘গুড। কন্ট্রাক্ট ভাল করে পড়েছেন তো?’
‘জী, ভাল করেই পড়েছি।’
‘দশটা-পাঁচটা অফিস। কাল সকাল থেকেই শুরু করেন তা হলে। আজকে এটুকুই। কাল দেখা হবে। আর, হ্যাঁ, যাওয়ার আগে মন্দাকিনীর সঙ্গে দেখা করে যাবেন। ও আপনার ছবি তুলবে। চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে ছবি থাকা জরুরি।’
বাসা থেকে বেরিয়ে এল অমল। ছবি ওঠাতে গিয়ে মন্দাকিনী অমলের জামার কলার ঠিকঠাক করার জন্যে বেশ কাছে চলে এসেছিল। নাকে এখনও তার চুলের সুবাস লেগে আছে।
সাত
হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডি লেক পার হয়ে মিরপুর রোডে এসে পড়ল অমল। ডানে মোড় নিয়ে হাঁটতেই থাকল। সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এসে থামল। এখন কোনদিকে যাবে ভাবতে লাগল সেই কথা। সোজা গেলে নিউ মার্কেট, আজিমপুর হয়ে মেসে ফেরা যাবে। বাস ধরে বাম দিকে গেলে গুলিস্তান, পীর ইয়ামেনী মার্কেট। অমল ভাবল, পার্কে গিয়ে দেখা করবে কামালের সঙ্গে। তবে চাকরি পাওয়ার কথাটা বলা যাবে না। বললেই এক শ’টা প্রশ্ন করবে এই ছেলে। জব সিক্রেসি আউট হয়ে যেতে পারে। প্রথম দিনই সব কিছু ভজকট করে ফেলা হবে চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা।
পার্কে এসে সেদিনের সেই বেঞ্চে বসল অমল। চারদিকে তাকিয়ে কামালকে খুঁজল। কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না তাকে। এখন কী করবে এই কথা যখন ভাবছে, ঠিক তখনই সালওয়ার-কামিজ পরা বিশ-একুশ বছরের একটা মেয়ে এসে বসল বেঞ্চটার অন্য মাথায়। বেণি করা চুলে ফিতে বাঁধা। পায়ে চামড়ার স্যাণ্ডেল। মুখে হালকা মেকাপ, ঠোঁটে লিপস্টিক। নাকে সাদা পাথর বসানো ছোট্ট নাক-ফুল, কানে নীল পাথরের ছোট ছোট দুল। খাটো হাতা ব্লাউজের বাইরে চমৎকার গোল বাহু। পুরু আঙুলের মাথায় মাংসে ডোবা চিকন চিকন নখ। কামিজের সাইড-কাট যথেষ্ট লম্বা হওয়ায় ঊরু সহ মাজার গড়ন বোঝা যাচ্ছে। প্রশ্নাতীত উরুর পুরুত্ব আর নিতম্বের গুরুত্ব। অমলের সঙ্গে চোখাচোখি হলো মেয়েটার। চোখে কোনও লাজুক ভাব নেই। তীরের মত সোজা দৃষ্টিতে সীমাহীন আলোর ঝলকানি। এ বারবণিতা। যৌবনে কুক্কুরীও সুন্দর। গায়ের রঙ একটু মাজা-মাজা হলেও স্বাস্থ্য ভাল মেয়েটার। বাজারে-মেয়েছেলেদের যেহেতু যৌনতাই পুঁজি, সে কারণে এদের দেখলেই হৃদয় ঝমঝম করে পুরুষের। মনের জানালা ধরে উঁকি-ঝুঁকি মারা শুরু করে হিয়ার আনাচে-কানাচে যত সুকৃত-বিকৃত কামনা-বাসনা। এদের কাজ নির্ভেজাল আনন্দ দেয়া। দেহ নিয়ে যা খুশি করতে চাও করো। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। তারপর রাস্তা দেখো। কোনও দায়-দায়িত্ব নেই। নো স্ট্রিং টায়েড। মানুষের আবেগগুলোর ভেতর যৌনাবেগ সব থেকে বেশি শক্তিশালী। এর কাছে পুরুষ অসহায়। অথচ এই আবেগ মেটাতে গেলে কাঁধে নিতে হয় বড় ধরনের দায়-দায়িত্ব, তার কাছে যেটা ভীষণ অপছন্দের। ওদিকে দায়-দায়িত্ব নিলেই যে সব কামনা-বাসনা মিটে যাবে এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। লাইসেন্সড্ কামনার বাইরেও আছে অসংখ্য আনলাইসেন্সড্ বাসনা। এজন্যেই বারবণিতার অভ্যুদয় মানব-সমাজের ঊষালগ্নে, পরিবার যখন কেবল গড়ে উঠি-উঠি করছে। উদগ্র কামনা- বাসনা যতদিন আছে, ততদিন আছে বারবণিতাও। প্রকৃতি চায় যেভাবেই হোক টিকে থাক মেয়েরা। পেশা নিয়ে বাছ- বিচার করার সময় কোথায়! অদ্ভুত এক আত্মতৃপ্তিও আছে বারবণিতাদের। যত বড়ে বড়ে খাঁ-ই হোক, কামার্ত পুরুষ আসলে ক্রীতদাসেরও অধম। ক্ষণিকের জন্যে হলেও মেয়েরাই প্রভু। একবার যদি মায়া লাগাতে পারে, তা হলে এই প্রভুত্ব হয় চিরকালের। এই দুর্বলতা ঢাকতেই পুরুষের যত হম্বিতম্বি।