‘বাহ্, বেশ চমৎকার বলেছেন তো! ইন্টারভিউতে পাশ করে গেছেন আপনি। শর্ত পূরণ করেছেন ঠিকঠাক মত। এখন আমার পালা। কোথায় আসতে হবে বলে দিচ্ছি। কাগজ-কলম আছে হাতের কাছে?’
‘জী, আছে।’
‘বেশ, ঠিকানা বলছি। লিখে নেন। ইচ্ছে করলে আজকেই বিকেল চারটার ভেতর জয়েন করতে পারেন।’
ফার্মেসির লোকটাকে ইশারায় কাগজ-কলম দিতে বলল অমল। তারপর লিখে নিল ঠিকানাটা। টেলিফোনে কথা-বলা লোকটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে রাগ। অমলের সঙ্গে একটা বোঝা-পড়ার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ‘লোকাল মাস্তান হলে খবর আছে,’ মনে-মনে ভাবল অমল। তাড়াতাড়ি লোকটার হাত ধরে বলল, ‘স্যর, কিছু মনে করবেন না। খুব জরুরি ফোন ছিল ওটা। চাকরির ইন্টারভিউ। এগারোটার ভেতরেই ফোন করার কথা। এজন্যেই আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করতে হয়েছে। মাফ করে দেন।’
‘চুপ কর্, ব্যাটা। বাতেলা করার জায়গা পাস না। তুই পার করছিস ছাগল, শেয়াল আর মিষ্টি কুমড়ো না কী ঘোড়ার ডিম। চাকরির ইন্টারভিউ এটা! গাঁড়ল পেয়েছিস আমাকে? যা খুশি তা-ই বোঝাবি? আমার জরুরি কথা শেষই হয়নি।’
‘স্যর, শোনেন, আপনার যা বিল হয়েছে দিয়ে দিচ্ছি। আপনি আবার ফোন করেন। এই যে, ফার্মেসির ভাই, উনার বিলটাও রাখেন। সঙ্গে দশ টাকা এক্সট্রা। পরের কলটার জন্যে।’
এবারে কাজ হলো। ফার্মেসির লোকটার দিকে তাকিয়ে মাস্তান এমন ভাব দেখাল, যেটাকে ভাষায় রূপান্তর করলে এই রকম হবে: দেখলি তো, কীভাবে লোককে টাইট করি? আমার সঙ্গে বিটলামি!
পাঁচ
কাগজে লেখা ঠিকানায় যে বাড়ি পাওয়া গেল, সেটা ধানমণ্ডি লেকের ধারে। পনেরো ফুট দেয়ালের ওপর পাঁচ ফুট কাঁটাতার। বিশ ফুট উঁচু গেট। এ বাড়ি এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। বড় গেটের পাশেই দেয়ালে লাগানো ছোট গেট। সবখানে ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা বসানো। পিপ-হোল টিপ-হোলের কোনও কারবারই নেই। তবে কলিং বেল আছে। কলিং বেল চাপতেই ছোট দরজা খুলে বেরিয়ে এল সাদা উর্দি পরা এক লোক। পেটা শরীর। উপজাতীয় টাইপ চেহারা। এ আসলে নেপালি গুর্খা। গুর্খা দারোয়ান রাখার চল ছিল ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তান পিরিয়ডে বিহারী দারোয়ান রাখা হত। ইয়া বড় গোঁফ। পালোয়ানের মত শরীর। এখন রাখা হয় চল ভাঙা, লুঙ্গি-পরা বাঙালি দারোয়ান। এদের প্রধান কাজ বাড়ি পাহারা দেয়া নয়। প্রধান কাজ হলো চাকরানিদের সঙ্গে ফিল্ডিং মারা আর বাড়ির সামনে মুদি দোকানে গিয়ে দোকানদারের সঙ্গে আড্ডা দেয়া। এ ছাড়াও আরও একটা কাজ আছে। সেটা হলো একে-তাকে ধরে কোনও রকমে একটা সরকারি অথবা বেসরকারি ফার্মে চাকরি ম্যানেজ করা যায় কি না, অনবরত সেই চেষ্টা করা।
গাড়ি বারান্দার দু’দিকে সবুজ ঘাসের বেডে ফুল গাছের ঝাড়। ফুল যা ফুটেছে, তা সবই লাল। লাল-সবুজের সমারোহ। এ লোক প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা নাকি? মনে-মনে ভাবল অমল। নেপালি দারোয়ান অমলকে নিয়ে ছোট একটা অফিস ঘরে বসাল। সেখানে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে ম্যানেজার মেম সাহেব বসে কী যেন লিখছে। গায়ের রঙ দেখলে যে কেউ বলবে গ্যালন গ্যালন আলকাতরা মাখানো হয়েছে মহিলার শরীরে। ঝামা কালো বললেও সবটুকু বলা হবে না। হালকা গোলাপি সুতি শাড়ি। খাটো-হাতা সাদা ব্লাউজ। নেপালি বলল, ‘মেম সা’ব, নায়া বাবু কো লায়া হুঁ।’
লেখা থামিয়ে মুখ তুলে অমলের দিকে তাকাল ম্যানেজার মেম সাহেব। একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল অমলের। এত সুন্দর চেহারা জীবনে কখনও দেখেছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ল না। এর তুলনা শুধু জাতীয় জাদুঘরে রাখা কষ্টি পাথরে তৈরি রাধার মূর্তির সঙ্গেই হতে পারে। এর চোখের মণি যদি হয় অমাবস্যার রাত, তা হলে বাইরের সাদা অংশটুকু হবে পূর্ণিমার চাঁদ। বাবার আমলের পাকিস্তানি সিনেমার নায়িকা জেবা আলির নাক। সুচিত্রার কপাল, কপোল আর চিবুক। রাখি গুলজারের ঠোঁট। মধুবালার দাঁত। কাঁধের ওপর ছড়ানো স্ট্রেট কালো রেশমী ক্লিওপেট্রা চুল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তুষারের মত নরম ওগুলো। কে বলে কালো মেয়ে সুন্দরী হয় না? এর পায়ের কাছে রাজা-বাদশারা গড়াগড়ি খাবে। তবে এ মেয়ের উপযুক্ত শুধুমাত্র একজন সম্রাটই হতে পারে। বিষাদ-মাখা চোখ মেলে স্পষ্ট গলায় মেম সাহেব জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি অমল কান্তি?’
‘জী, আমিই অমল কান্তি।’
‘একটু বসেন। স্যরকে জানাই আপনি এসেছেন।’
এরপর ইন্টারকমে এক ডায়াল করল মেয়েটা। ওপারে রিসিভার উঠতেই বলল, ‘স্যর, অমল বাবু এসেছেন। নিয়ে আসব? কোথায় বললেন? লিভিং রুমে? আচ্ছা, ঠিক আছে, এখনি নিয়ে আসছি।’ এরপর ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা ফাইল বের করে অমলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলেন। স্যর অপেক্ষা করছেন।’ অমল ঘুরে দাঁড়াতেই তার চোখে পড়ল দরজার ওপর এক প্যানেলে ছয়টা ক্লোজড সার্কিট টিভি স্ক্রিন। আ-চ্ছা, তা হলে এখান থেকেই অমলের আসার ব্যাপারটা টের পেয়েছে ম্যানেজার মেম সাহেব।
ছয়
ম্যানেজার মেমের পিছে-পিছে বিশাল এক হলঘরে এসে উপস্থিত হলো অমল। দোতলা বাড়ির নিচের তলার অর্ধেকটাই বোধ হয় লিভিং রুম। লম্বা-লম্বা আলমারি ভর্তি পাঁজা পাঁজা পুরনো বই। একপাশে কেমিকেল ল্যাবরেটরি। উল্টোপাশে কাচের টেবিলের ওপর ইয়া মোটা, বেঁটে আর লম্বা সব টেলিস্কোপ। ওগুলোর পাশে ইমেজ প্রিজম আর স্টেইনলেস স্টিলের অ্যাস্ট্রোলোব। খাতা-পেন্সিল, ক্যালকুলেটর। ওদিকটাতে ইঁটের দেয়ালের বদলে বিরাট- বিরাট কাঁচ বসানো। ঘরের ছাতেও কাঁচের পাল্লা বসানো। চাইলেই খোলা যাবে ওগুলো। বার্গাণ্ডি রঙের ভেলভেটের পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কাঁচের দেয়াল আর ছাত। ঘরের মাঝখানে সাদা রঙের শ্বেত-পাথরে মোড়া নিচু চারকোনা বেদি। সম্পূর্ণ খালি বেদিটা। বেদির পেছনে মজবুত কাঠের পেডেস্টালের ওপর ভারী ছাই রঙা কাপড়ে ঢাকা প্রায় মানুষ সমান কিছু একটা। মূর্তি-টুর্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ঘরের আরেকদিকে দুই সেট সোফা। এখানে-সেখানে টেবিল, কুশন, ডিভান, রকিং চেয়ার। যত্রতত্র ফুলদানি। বিশ-ত্রিশটার কম হবে না। সবগুলোতে সাদা ফুল। ফুলের গন্ধে ম-ম করছে ঘরের ভেতরটা। পুরো ঘরটাতেই কালো-সাদা মার্বেল টাইল্স্ বসানো। দেখে মনে হয় বিশাল দাবার ছক বানিয়েছে কেউ।