হঠাৎ করেই তার মনে হলো, বসে থেকে আর কী হবে। তার চেয়ে বরং একবার এপার-ওপার করে দেখা যাক। নদীর জোলো বাতাসে মাথাটা খুললেও খুলতে পারে। দু’টাকা দিয়ে টিকেট কেটে নৌকোয় চড়ে বসল অমল। নৌকো প্রায় ভরেই গেছে। ছেড়ে দেবে যে-কোনও সময়। ঠিক তখনই ছাতা বগলে নিয়ে হনহন করে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ঘাটে এসে উপস্থিত হলো। টিকেট কিনে নৌকোয় উঠতে যাবে, এমন সময় কী মনে করে পিছিয়ে এসে পানের দোকানে গিয়ে এক খিলি পানের অর্ডার দিল লোকটা। ‘ছাতাটা দোকানের শোকেসের সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখে বিল মিটিয়ে পানের বোঁটায় চুন নিতে লাগল। ওদিকে নৌকো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে পারানি। লোকটাকে দেখে মনে হলো, হুড়োহুড়ি করে নৌকোয় ওঠার কোনও তাড়া নেই। ভাবছে, ধীরেসুস্থে পরের নৌকোয় গেলেই চলবে। এমন সময় নৌকোর ওপর থেকে কেউ একজন দেখতে পেল লোকটাকে। চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, ‘এই যে, জামাইবাবু, এই, জামাইবাবু!’
মুখভর্তি পান নিয়ে চমকে ফিরে তাকাল লোকটা। হাসি মুখে এগিয়ে এল নৌকোর দিকে। নৌকোয় উঠে যে ছেলেটা তাকে ডেকেছিল, তার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘আরে, ফটিক! তুই কোত্থেকে?’
‘মানিকগঞ্জ থেকে আসছি, জামাইবাবু। মেজদি’র ওখানে গিয়েছিলাম।’
‘ওহ্, তাই নাকি? তা ওরা সব ভাল তো?’
‘আজ্ঞে ভালই। কিন্তু আপনি এখানে? ওপারে যাচ্ছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ রে, ফটকে। ওপারে এক লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’
এরপর এটা-সেটা নানান কথা বলাবলি করতে লাগল শালা-জামাইবাবু। নৌকো ভিড়ে গেল ঘাটে। এক-এক করে সবাই নেমে গেল। নামল শালা-জামাইবাবুও। অমল নৌকো থেকে নামলই না। এই নৌকোতেই ওপারে ফিরে যাবে সে। পাড় বেয়ে ওপরে উঠতে যাবে, ঠিক এমন সময় থমকে দাঁড়াল জামাইবাবু। বলল, ‘এই, যাহ্। ওরে, ফটকে, ছাতাটা যে ওপারে ফেলে এলাম আমি! তুই এক কাজ কর। দাঁড়া এখানে। দশ-পনেরো মিনিটেরই তো ব্যাপার। ওপারে গিয়ে পানের দোকান থেকে নিয়ে আসি ছাতাটা। নতুন ছাতা। হারিয়ে ফেললে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে তোর বড়দি’। এত করে বললাম ছাতা-ফাতার দরকার নেই, তারপরেও জোর করে দিয়ে দিল। বলল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। জলে ভিজে জ্বর বাধালে রুগী টানতে পারব না। এখন যদি গিয়ে বলি ছাতা হারিয়েছি, তা হলে বাড়ি মাথায় তুলবে। কেন যে বিয়ে করে মানুষ! এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পিছালেও নির্বংশের ব্যাটা!’
ঘুরে এসে ফের নৌকোয় উঠল জামাইবাবু। অমলের সঙ্গেই ওপারে ফিরে যাবে। নৌকো ছেড়ে দিতেই সদরঘাটের দিকে তাকাল অমল। লক্ষ করল জামাইবাবুও ওদিকেই তাকিয়ে আছে। আর ঠিক তখনই ধাঁধার উত্তরটা মাথায় এল অমলের। চট করে হাতঘড়ির দিকে তাকাল অমল। সাড়ে দশটা বাজে। নদী পার হতে লাগবে পনেরো মিনিট। ওপারে পৌঁছার পর সময় হাতে থাকবে মাত্র পনেরো মিনিট। এই পনেরো মিনিটের ভেতরই ফোনের কাছে পৌঁছতে হবে। এখন সময় মত ফোন পেলে হয়। তীরে এসে শেষে না আবার তরী ডোবে!
চার
ওপারে পৌঁছে হন্যে হয়ে ফার্মেসি খুঁজতে লাগল অমল। ফোন থাকলে ওখানেই থাকবে। দশ মিনিট ধরে খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেল ফার্মেসি। কাউন্টারের একপাশে রাখা হয়েছে ফোন। পাশে ফুলস্কেপ কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে লেখা: ‘প্রতি কল দশ টাকা। তিন মিনিট পর প্রতি মিনিট এক টাকা।’ দিন-দুপুরে ডাকাতি। ফার্মেসির ওষুধ বেচে যা আয়, তার থেকে ঢের বেশি টেলিফোন থেকে। খালি নেই ফোন। এক লোক কথা বলছে। কাজের কোনও কথা না। ফালতু আলাপ। ফার্মেসির লোকটাকে অমল জানাল, সে ফোন করতে চায়। জরুরি। লোকটা বলল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন একজন লাইনে আছে। ওর কথা শেষ হোক, তারপর বলবেন। ‘
এদিকে দু’মিনিট শেষ।
এগারোটা বাজতে তিন মিনিট বাকি!
খেপে গেল অমল। ফার্মেসির লোকটার হাত জোরে চেপে ধরে বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না। খুব জরুরি ফোন করতে হবে আমাকে। ওই লোকটাকে বলেন ফোন রাখতে। বুঝেছেন?’
অমলের দিকে তাকিয়ে রইল লোকটা। নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।
আর দু’মিনিট বাকি!
এইবার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল অমলের। ছুটে গিয়ে রিসিভার কেড়ে নিয়ে লাইন কেটে দিল সে। কিন্তু ফোন নম্বর! কোথায় ওটা? গতকাল যে শার্ট পরেছিল, ফোন নম্বর লেখা কাগজটা ছিল সেই শার্টের পকেটে। আসার সময় কোন্ শার্ট পরে এসেছে মনে করতে পারল না। ‘হে, ভগবান, রক্ষে করো,’ মনে-মনে ভাবল অমল।
নাহ্, ভাগ্য ভাল।
ওই একই শার্ট আজ সকালেও পরে বের হয়েছে সে। মনের ভুলেই হয়তো পরেছে। যা হোক, পকেটেই আছে নম্বরটা।
এগারোটা বাজতে আর এক মিনিট বাকি!
রিং হচ্ছে!
তিনবার রিং হতেই ওপারে কেউ ফোন ধরল। আগন্তুক তার নাম বলেনি। অমল ধরেই নিল ও প্রান্তে আগন্তুকই ধরেছে ফোনটা।
‘হ্যালো, অমল বলছি। আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি।’
‘ধাঁধার উত্তরটা দিতে চাই। বলব?’
‘বলেন।’
‘প্রথমে পার করতে হবে ছাগলটাকে।’
‘বেশ। তারপর?’
‘এরপর বাঁধা কপিটা নিয়ে এপারে আসতে হবে।’
‘বলে যান।’
‘বাঁধা কপিটা এপারে রেখে আবার ছাগলটাকে উঠিয়ে নিতে হবে নৌকোয়। তারপর ছাগলটাকে ওপারে রেখে নিয়ে আসতে হবে শেয়ালটাকে। শেয়ালটাকে এপারে বাঁধা কপিটার সঙ্গে রেখে নৌকো নিয়ে আবারও ওপারে ফিরে যেতে হবে। তারপর ছাগলটাকে নৌকোয় উঠিয়ে নিয়ে আসতে হবে এপারে। ব্যস, পার হয়ে যাবে তিনটে জিনিসই। ক্ষতি হবে না কোনওটারই। কয়বার পারাপার করা যাবে এ ব্যাপারে কোনও শর্ত আপনি দেননি। অতএব ‘এটাই সঠিক উত্তর।’