যুবক বুড়িকে সব খুলে বলল। সব শুনে বুড়ি বলল, ‘শোন, নাতি, সমস্যার সমাধান আমি করে দেব। তবে শর্ত আছে।’
‘নে, বাবা। খালি শর্ত আর শর্ত। শর্ত ছাড়া জীবনে কি কিছু নেই নাকি? ওসব শর্ত-ফর্তের মধ্যে আমি আর নেই। এমনি এমনি বললে বলেন, না হলে রাস্তা দেখি। কপালে মরণ লেখা থাকলে কারও বাবাও ঠেকাতে পারবে না।’
‘আরে, বাবা, আগে শোনই না! শর্ত শুনে যদি মনে হয় মানতে পারবে, তা হলে আর কথা কী? শর্ত বলব?’
‘আচ্ছা বলেন, কী শর্ত?’
‘শর্ত হলো ধাঁধার উত্তর বলে দেব আমি। তবে তুমি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে করবে আমাকে।’
‘এ আবার কী শর্ত! আপনার বয়সের তো গাছ-পাথর নেই। কবরে এক পা চলেই গেছে। এখন বিয়ে-শাদি বাদ দিয়ে ভগবানকে ডাকেন। আপনার হাঁটুর বয়সও হবে না আমার। এ অসম বিয়ে হলে হাসাহাসি করবে লোকে।’
‘ভেবে দেখো, তোমার জীবন তো বাঁচবে। আমি থুরথুরে বুড়ি। ফট করে মরে যাব যে-কোনও দিন। তারপরেই তুমি মুক্ত। যাকে খুশি বিয়ে করতে পারবে। কী, রাজি?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনার শর্ত মেনে নেব। এখন ধাঁধার উত্তর বলেন।’
‘কাল সকালে রাজকন্যাকে গিয়ে বলবে, ‘সব মেয়ের কামনা একটাই: স্বামীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব।’’
পরদিন সকালে রাজদরবারে গিয়ে রাজকন্যার ধাঁধার উত্তর দিল যুবক। খুশি হলো রাজকন্যা। রাজকর্মচারীদের বলল বিয়ের আয়োজন করতে। কিন্তু বাদ সাধল যুবক। বলল, ‘মহামান্য রাজকন্যা, ধাঁধার উত্তর বার করতে গিয়ে আমাকে এত বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয়েছে যে বিয়ের সাধ মিটে গেছে আমার। এখন যদি প্রাণ ভিক্ষা দেন তো বাঁচি। যদি অনুমতি দেন তো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে চাই।’
যুবক মনে মনে ভেবে রেখেছিল রাজদরবার থেকে বেরিয়েই সোজা নিজ গ্রামে ফিরে যাবে। বাড়িতেই কাটাবে বাকি জীবন। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছে। বারবার ভাগ্য সহায়তা করবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরুতেই দেখল রাস্তার ধারে সেই খুনখুনে বুড়ি দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছে তার জন্যে। আদ্যিকালের কোঁচকানো সাদা পোশাক পরে এসেছে। এককালে পোশাকের রঙ হয়তো সাদা ছিল, তবে কালের পরিক্রমায় বর্তমানে অফহোয়াইট। মাথায় লম্বা সাদা স্কার্ফ। হাতে ফুলের তোড়া। বিয়ের জন্যে সম্পূৰ্ণ প্ৰস্তুত!
বুড়ি আর যুবকের বিয়ে হয়ে গেল দুপুরের আগেই। বিকেলটা তারা কাটাল শুঁড়িখানায় মদ খেয়ে। এরপর ফুলশয্যার রাত। প্রচণ্ড মন খারাপ যুবকের। কী ভেবেছিল আর কী হলো? কোথায় ঢলঢলে যুবতী রাজকন্যা আর কোথায় এই কুৎসিত থুরথুরে বুড়ি! ওহ্, ভগবান, এর থেকে মরলেই ভাল ছিল! যুবককে বিছানায় বসিয়ে রেখে বুড়ি গেল কাপড় পাল্টাতে। বুড়ি গেছে তো গেছেই। এদিকে বিছানায় বসে চোখের জল ফেলছে যুবক। হঠাৎ কাপড়ের খসখস শব্দে সংবিৎ ফিরল তার। বুঝতে পারল অপূর্ব সুগন্ধে ভরে গেছে ঘর। কোত্থেকে যেন নীলাভ আলোও আসছে। মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল অনিন্দ্যসুন্দরী এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখের তারায় আলোর ছটা, পাতলা গোলাপি ঠোঁটের নিচে মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত। টোল পড়া গালে ভুবন-ভোলানো হাসি। চোয়াল ঝুলে পড়ল যুবকের। এ আবার কোন্ নাটক শুরু হলো! যুবতী বলল, ‘কী হলো, চিনতে পারছ না? এরই মধ্যে ভুলে গেলে বউকে?’
‘কিন্তু আমার বউ তো তুমি নও। আমার বউয়ের বয়স আমার দাদীর চেয়েও বেশি।’
‘ও, বাবা! বিয়ের পর একটা দিনও যায়নি, এরই মধ্যে খোঁটা দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছ?’
‘যা সত্যি তা-ই বলছি। ছল-চাতুরি বুঝি না আমি।’
‘আমিই সেই বুড়ি। আমি আসলে ডাইনী। ইচ্ছেমত রূপ বদলাতে পারি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে, সেজন্যেই বিয়ে করেছি। এখন বলো, আমাকে কোন্ রূপে পেতে চাও? যদি বলো এখন যেমন আছ তেমনই থাকো, তা হলে একটা শর্ত মানতে হবে-এইটে দাবি করতে পারবে না যে আমি সতীপনা দেখিয়ে বেড়াব। যাকে মনে ধরবে, তার সঙ্গে প্রেম করার অধিকার চাই আমি। আর যদি আগের রূপে থাকতে বলো, তা হলে কথা দিচ্ছি, কারও দিকে ফিরেও তাকাব না কোনও দিন। আমি শুধু তোমারই থাকব। এখন বলো কোটা চাও।’
সব শুনে যুবক বলল, ‘শর্ত শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমার। তোমরা মেয়েরা শর্ত না জুড়ে কথাই বলতে পারো না। যা মন চায় করো, বাবা। যেভাবে থাকতে চাও, থাকো। বিয়ে যখন করেই ফেলেছি, তখন বুড়িই কী আর ছুঁড়িই কী? বাদ তো আর দিতে পারব না।’
যুবকের কথা শুনে খুশি হলো ডাইনী। বলল, ‘বাব্বা, জনাবের রাগ তো কম নয় দেখছি! আচ্ছা যাও, এখন যেভাবে আছি, আমাকে পাবে সেভাবেই। আর পুরো বিশ্বস্তও থাকব চিরকাল। কী, দুলহা রাজা, হয়েছে? এবার একটু হাসো তো দেখি।’
.
সূত্রাপুর থানার পেটা ঘড়িতে ভোর চারটে বাজার আওয়াজ শুনল অমল। খিদেয় গুড়গুড় করছে পেট। ভাত খেতে গিয়ে দেখল টক হয়ে গেছে অড়হরের ডাল। করলা ভাজি অ্যায়সা তেতো যে মুখেই দেয়া যাচ্ছে না। মিষ্টি কুমড়োর ঘণ্টে ইলিশ মাছের চ্যাপ্টা কানকোর ছোট একটা টুকরো ছাড়া অন্য কিছু নেই। কী আর করা, কানকোর টুকরোটাই চুষে খেল। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এল চোখে। রাতে স্বপ্ন দেখল ইস্ট লণ্ডনের তস্য গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। সুনসান নীরবতা। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের কয়লা পোড়ানো গ্যাস-বাতির টিমটিমে ভুতুড়ে আলোয় হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ক্ষুর দিয়ে ফালি ফালি করে কাটা যুবতী নারীর লাশ। রক্তে মাখামাখি ধূসর রঙের গাউন, দুধ-সাদা নিটোল বুক। কবল-স্টোন রোডের পাথরের খাঁজ বেয়ে থিকথিক করে গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। যুবতীর হাত-পাগুলো তিরতির করে কাঁপছে তখনও। লম্বা-লম্বা পা ফেলে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে কালো রঙের গ্রেট কোট আর মাথায় চার্চিল হ্যাট পরা জ্যাক দ্য রিপার। বিড়বিড় করে বলছে, ‘এই বেশ্যা মাগিটাও আমার ধাঁধার উত্তর দিতে পারল না। কিছু দিন পর আর একটাকে ধরতে হবে। যত্তসব অপদার্থের দল!’
তিন
অমলের ঘুম ভাঙল সকাল আটটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল ধাঁধার কথা। কিন্তু কোথায় উত্তর? আগে যে তিমিরে ছিল, এখনও সেই তিমিরেই আছে। অমল ভাবল, মেস থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটবে। সকালের আলো-হাওয়ায় মাথাটা খোলতাই হবে। বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেল টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে সদরঘাটে চলে এল অমল। আহসান মঞ্জিলের কাছে বুড়িগঙ্গার ধারে বসল। এপারে সদরঘাট, ওপারে কেরানিগঞ্জ। ছোট-বড় নৌকোয় লোক পারাপার হচ্ছে। বাঁশের মাচায় বসে আছে যেসব মাস্তানেরা, ঘাট ডেকেছে তারা। দু’টাকা ভাড়া দিয়ে নৌকোয় উঠতে হয়। আশপাশে চা-পান আর বিড়ি- সিগারেটের দোকান। এক ঘণ্টা ধরে লোক পারাপার দেখল অমল। দশটা বেজে গেল। ধাঁধার উত্তর মিলছে না কিছুতেই। আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে। কিছু ভেবে বার করতে পারলে ভাল। না হলে? নাহ্, পরের অংশটুকু আর ভাবতে চায় না অমল।