অমলের মনে পড়ল কলেজে ইংরেজি প্রফেসরের বলা একটা গল্পের কথা। অনেক দিন আগে লণ্ডনের নাম যখন লণ্ডনিয়াম, তখন সেখানে গ্রাম থেকে অভাবের তাড়নায় এক যুবক এসে হাজির হলো। হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে লাগল ছেলেটি। দিন যায়, যায় সপ্তাহ, কিন্তু কাজ আর পায় না। এদিকে শেষ হয়ে এসেছে পকেটের রেস্ত। একদিন গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে কখন যে সে রাজপ্রাসাদের সামনে এসে পড়েছে, খেয়ালই করেনি। আসলে রাজপ্রাসাদ দেখতে কেমন সেইটেই জানত না। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাজপ্রাসাদ দেখতে লাগল সে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে এক জনসমাবেশ। বড় একটা পাথরের প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো। বিষয় কী? না, এক যুবকের শিরচ্ছেদ হচ্ছে। শিরচ্ছেদের কারণ রাজকন্যার ধাঁধার উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে সে। খোঁজ-খবর নিয়ে গ্রাম থেকে আসা যুবক জানতে পারল রাজকন্যাকে যে-কোনও ছেলে বিয়ে করতে পারে। শর্ত হলো: তার ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে হবে। ভুল উত্তর দিলে কাটা পড়বে মুণ্ড। ধাঁধার উত্তর ভেবেচিন্তে বের করার জন্যে এক বছর সময় দেয়া হবে। যুবক ভাবল জীবনে ঝুঁকি একটা নিতেই হবে তাকে। নো রিস্ক নো গেইন। প্রাসাদের গেটের সামনে রাখা ইয়া বড় কাঁসার ঘণ্টায় বাড়ি দিয়ে রাজকন্যাকে বিয়ের ইচ্ছে জানাল যুবক। এরপর তাকে নেয়া হলো রাজদরবারে। সেখানে রাজার পাশে বসে রাজকন্যা শোনাল তার ধাঁধা। বলতে হবে: ‘মেয়েরা কোন জিনিস সবচেয়ে বেশি কামনা করে।’ এক বছর সময় দেয়া হলো যুবককে। দেয়া হলো প্রচুর টাকা-পয়সা, থাকার জায়গা, চাকর-নফর। সেই সঙ্গে রাখা হলো প্রহরী-যুবক যাতে পালাতে না পারে। ঘোরাঘুরির স্বাধীনতা তার আছে। তবে ঘুরতে হবে পায়ের গোড়ালিতে প্রহরী নিয়ে। প্রথম ছ’মাস যেখানে যত বই পেল, সব পড়ার চেষ্টা করল যুবক। এরপর ধর্মগুরু, সমাজগুরু, দার্শনিকগুরু-এঁদের সঙ্গে আলোচনা করে কাটাল আরও পাঁচ মাস। কিন্তু নাহ্। নিশ্চিন্ত হওয়ার মত কোনও উত্তরই পাওয়া গেল না। বাকি আছে আর মাত্র ত্রিশ দিন! প্ৰথম পনেরো দিন কাটল ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। তার পরের সপ্তাহ শেষ হলো নিজের কামরায় সকাল-সন্ধ্যা শুয়ে- বসে। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি! যুবক সিদ্ধান্ত নিল শেষ দিনগুলো নদীর ধারে বসে কাটাবে। নদীর ধারে সারাদিন বসে থাকে সে। তাকিয়ে থাকে টলটলে জলের দিকে। দেখতে পায় পাল তোলা নৌকো। ওপারে সবুজ ফসলের খেতে কাজ করছে কৃষক। দুপুরে গাছতলায় বসে বউয়ের আনা খাবার খাচ্ছে। গ্লাসে জল ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে বউ। খাওয়া শেষ হলে থালাবাটি নদীর জলে ধুয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে কৃষক-বউ। আহ্, কী মধুর এই জীবন! শুধু যদি বেঁচে থাকতে পারতাম! কী কুক্ষণেই যে রাজকুমারীকে বিয়ে করার সাধ জেগেছিল! বামুন হয়ে চাঁদে হাত! এখন আম-ছালা সবই গেল-মনে মনে ভাবে যুবক। খুব আফসোস হয় তার। কিন্তু কী আর করা? এক বছর পূর্ণ হতে আর যখন মাত্র একদিন বাকি, ভয়ানক মুষড়ে পড়ল সে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগল মাথা হেঁট করে। কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই। খেয়াল করেই বা কী লাভ? হঠাৎই লক্ষ করল নির্জন এক জায়গায় চলে এসেছে সে। সামনেই ভাঙাচোরা আদ্যিকালের মন্দিরের মত কী যেন। ঝকঝক করছে নিরেট পাথরে তৈরি চত্বর। যুবক ভাবল মন্দির-চত্বরে কিছুক্ষণ বসবে। মনটা হয়তো হালকা হবে এতে। ভেঙে পড়া একটা পাথরের দেয়ালের ওপর বসে আবারও গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। হঠাৎ মনে হলো পা টেনে টেনে কে যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল, লাঠিতে ভর দিয়ে খুনখুনে এক বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ধনুক-বাঁকা পিঠ, শণের গোছা চুল, মুখ কোঁচকানো টমেটো, শালগম থুতনি। অল্প-স্বল্প দাড়িও আছে সেখানে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই থাকতে পারছে না। একদিকে হেলে যাতে পড়ে না যায় সেই প্রচেষ্টাতেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে শরীরের সবটুকু বল। যুবককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখ খুলল বুড়ি। ওখানে আছে কালো ছোট একটা জিভ আর গোলাপি মাড়ি। দাঁত নেই একটাও। নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধে গাছের ডালে বসা পাখি উড়ে যাবে। বুড়ি বলল, ‘কী, নাতি, এই বয়সেই এত চিন্তা কীসের? এটা তো ফুর্তি করার সময়। যা হবার তা-ই হবে। কী হবে আর ভেবে ভেবে? বরং শুঁড়িখানায় যাও। উড়িয়ে দাও দু’চার পেগ। এরপর ডবকা দেখে এক ছুঁড়ি জোগাড় করে নিয়ে যাও বাড়িতে। আয়েশ করো।’
বুড়ির কথা শুনে দুঃখের ভেতরও হেসে ফেলল যুবক। বলল, ‘শোনেন, বুড়ি মা। বিরাট বিপদের ভেতর আছি। মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে চাইলেও পারব কি না কে জানে!’
‘এই কাঁচা বয়সে আবার কী সমস্যা গো, নাতি? কুমারী মেয়ের পেট বাধিয়ে ফেলেছ? নাকি কারও বউয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে সব লেজেগোবরে করেছ?’
‘আরে, বাবা, এসবের কোনটাই না। আমার সমস্যা, জীবন-মরণ সমস্যা। নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছি। এখন আর কে বাঁচাবে? জীবনে করতে পারলাম না কিছুই।’
‘সমস্যাটা বলোই না শুনি। সমাধান তো হয়েও যেতে পারে। কে জানে!’
‘আচ্ছা শোনেন তা হলে। এমনিও মরব, ওমনিও মরব। আপনার আকাঙ্ক্ষা তো পূর্ণ হোক।’