‘ওরে, বাবা! আপনার জীবন তো দেখি, ভাই, ষাটের দশকের কোলকাতার বাংলা সিনেমা। সে যাই হোক, আপনার একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়তো করতে পারব। তবে ইন্টারভিউ দিতে হবে আপনাকে। যদি পাশ করতে পারেন, তা হলে চাকরি পাবেন। দিতে চান ইন্টারভিউ?’
‘দেব। কোথায়, কখন যেতে হবে বলেন।’
‘কোথাও যেতে হবে না। যদি চান, তা হলে এখানেই ইন্টারভিউ দিতে পারেন। এখনই।’
‘তাই নাকি? কে ইন্টারভিউ নেবে? কোন্ কোম্পানি?’
‘আমিই ইন্টারভিউ নেব। পাশ করলে চাকরি করবেন আমার অফিসে। কোন্ অফিস? কোথায় অফিস? এসব জানতে পারবেন ইন্টারভিউ-এ পাশ করার পর। ঠিক আছে?’
‘জী, ঠিক আছে। বলেন কী জানতে চান।’
‘আমি আপনাকে একটা ধাঁধা বলব। তবে ধাঁধার উত্তর যে এখনই দিতে হবে তেমন কোনও শর্ত নেই। আগামীকাল সকাল এগারোটা পর্যন্ত সময় পাবেন। ফোন নম্বর দিয়ে যাব। উত্তরটা যদি আগামীকাল দেন, তা হলে ফোন করে জানাবেন। উত্তর সঠিক হলে কোথায় যেতে হবে বলে দেব। কী, রাজি?’
‘জী, রাজি। ধাঁধাটি কী?’
‘বলছি, মন দিয়ে শোনেন। ধাঁধা বলার সময় বা বলা শেষ হলে কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না। শুধু উত্তর দিতে পারবেন। আর সেই সুযোগ পাবেন মাত্র একবার। এই শর্তগুলোর একটাও ভঙ্গ করা যাবে না। বোঝা গেছে?’
‘জী।’
‘ধাঁধাটা হলো এই: একটা লোক তিনটে জিনিস নিয়ে নৌকো করে ছোট একটা নদী পার হবে। কিন্তু নৌকোটা এতই ছোট যে একবারে সে শুধু একটা জিনিসই নিতে পারবে। অর্থাৎ, একেকবারে একটা করে জিনিস নিে ওপারে গিয়ে সেই জিনিসটা রেখে ফের এপারে এসে আরেকটা নিয়ে যাবে। তবে সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো যে তিনটি জিনিস সে ওপারে নিয়ে যাবে- সেগুলোতে। তিনটে জিনিস হলো: একটা শেয়াল, একটা বাঁধা কপি, আর একটা ছোট ছাগল। এখন লোকটা যদি বাঁধা কপি নিয়ে ওপারে যায়, তা হলে শেয়াল ছাগলটাকে একা পেয়ে খেয়ে ফেলবে। আর প্রথমে যদি শেয়াল নিয়ে ওপারে যায়, তা হলে সেই সুযোগে ছাগলটা খেয়ে ফেলবে বাঁধা কপি। লোকটাকে ঠিকঠাক মত এই তিনটে জিনিসই নদীর ওপারে নিতে হবে। কোনটারই কোনও ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না। মনে রাখবেন, এপারে যেমন সুযোগ পেলে শেয়াল ছাগলটাকে কিংবা ছাগল বাঁধা কপিটাকে খেয়ে ফেলবে, সেই একই ব্যাপার কিন্তু ঘটবে ওপারেও। এটাই ধাঁধা। এখন বলেন কীভাবে ঠিকঠাক মত জিনিসগুলো ওপারে রেখে আসা যাবে।’
এতক্ষণ কামাল চুপচাপ ছিল। ধাঁধা শোনার পর সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। আগন্তুককে বলল, ‘ছার, সওয়ালের জওয়াব আমি দিলে অইব?’
‘তুমি দিতে চাও? ঠিক আছে, দাও। উত্তর যদি সঠিক হয়, তা হলে ধরে নেব অমল বাবু ইন্টারভিউতে পাশ করেছেন।’
‘ছার, প্রথমে পার করন লাগব খাসিডারে। এইপারে খ্যাক শেয়ালে তো আর বান্দা কপি খাইতে পারবে না।’
‘বেশ, তারপর?’
‘হেরপর বান্দা কপিডারে নৌকাত উডায়া নিতে হইব ওইপারে। কপিডারে রাইখা হেরপর এইপারে আইয়া নিব খ্যাক শেয়ালডারে। ব্যস, কাম শ্যাষ।’
‘উঁহুঁ ‘কাম শ্যাষ’ না। লোকটা যখন বাঁধা কপি রেখে শেয়াল আনতে যাবে, সেই সুযোগে বাঁধা কপি খেয়ে ফেলবে ছাগল। লোকটা শেয়াল নিয়ে ফিরে এসে দেখবে বাঁধা কপি শেষ। সমস্যাটা বুঝতে পেরেছ?’
‘অ্যাঁ? এইডা তো, ছার, খেয়াল করি নাই। বিষয়ডা তো, ছার, মনে লয় বহুত জটিল!’
‘তা, কিছুটা জটিল তো বটেই।’
আগন্তুক এবার অমল কান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ভাবছেন, অমল বাবু? উত্তর কি এখনই দেবেন, না কাল সকাল পর্যন্ত সময় নেবেন?
‘কাল সকাল অব্দি সময় চাই।’
‘ঠিক আছে। সকাল পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। তবে মনে রাখবেন, এগারোটার পর সঠিক-বেঠিক কোনও উত্তরই গ্রহণযোগ্য হবে না। সময়ই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। সময় হচ্ছে স্বয়ং ভগবান। এই নেন ফোন নম্বর। উত্তরটা ফোনে জানাবেন।’
‘আপনার নামটা তো জানা হলো না।’
‘ইন্টারভিউতে পাশ করলে জানতে পারবেন, এখন না।’
উঠে পড়ল আগন্তুক। কামালের হাতে এক শ’ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল পার্ক থেকে। গাড়ির দরজা খুলে দিল ড্রাইভার।
দুই
অমল কান্তি যখন মেসে ফিরল, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। মেসে ঢোকার সময় দেখা হলো মেস ম্যানেজার বিনয় বোসের সঙ্গে। মান্ধাতা আমলের তেলতেলে হাতলঅলা পিঠ-বাঁকা বেঞ্চিতে পা উঠিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। মেঝের ওপর চামড়ার কোলাপুরি চটি। খুব সম্ভব বিনয় বাবুর শ্বশুরের আমলের। চটির জগতের ডাইনোসর। অরিজিনাল বহু আগেই খতম হয়ে গেছে। মুচির কল্যাণে জোড়া লাগানো ফসিল। পরনে হাতাঅলা সাদা গেঞ্জি, ধুতি। গলায় কাঠের মালা। বেঞ্চের কাঠ যত তেলতেলে, তার থেকেও ঢের বেশি তেলতেলে কাঠের মালা। জন্মের পর থেকেই সম্ভবত বোস বাবুর গলায় ঝুলছে ওটা। মাথার ওপর ঘড়ঘড় করে চলছে পাকিস্তান আমলের হীরা ফ্যান। শেষ কবে ক্যাপাসিটর পাল্টানো হয়েছিল ভগবান বলতে পারবেন। এই ফ্যানের চরিত্র একসময় ফ্যানের মত হলেও এখন এর কুকুর স্বভাব। আওয়াজ যত বেশি, কাজ তত কম।
বিনয় বোস অমলের দিকে ফিরেও তাকালেন না। খবরের কাগজ পড়তেই থাকলেন। অমল যে একটা অপদার্থ সেই ধারণা বিনয় বাবুর একেবারে গোড়া থেকেই। এখন যদি জানতে পারেন তার চাকরি নেই, তা হলে সেই ধারণা হবে ধর্মীয় বিশ্বাসের মত চিরন্তন। রুমে গিয়ে কাপড়- চোপড় ছেড়ে চকির ওপর শুয়ে পড়ল অমল। ধাঁধার উত্তর নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। সে আছে এক ঘোরের ভেতর। বামুন ঠাকুর এসে খাবার দিয়ে গেছে। ইলিশ মাছের মাথা আর কাঁটাকুটি দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো ঘণ্ট। তার সঙ্গে করলা ভাজি, অড়হরের ডাল। টেনশনের ঠেলায় খিদেই নষ্ট হয়ে গেছে। এ জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি যে হতে হয়! ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান। নিজের অস্তিত্ব, মা-ভাই- বোনের খোরপোষ সব নির্ভর করছে একটা ধাঁধার উত্তরের ওপর। হায়রে নিয়তি!