.
হঠাৎ অমল কান্তির চোখে পড়ল সিটি কর্পোরেশনের অফিসের ওদিকটায় সাদা এক গাড়ি থেকে লম্বা একহারা গড়নের মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক নামছে। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে কালো চামড়ার ফিতেঅলা স্যাণ্ডেল। চোখে কালো সানগ্লাস। সোজা অমল কান্তির সামনে এসে থামল লোকটা। বোঝাই যাচ্ছে দূর থেকেই কামালের ‘টুল- বক্স’ দেখতে পেয়েছে। ওই বাক্সই বেঞ্চটার কাছে টেনে এনেছে তাকে। অমল দেখল ঘসঘসে কালো চুল লোকটার। সম্ভবত কলপ দেয়া। তবে মুখ আর হাত দেখে থমকে যেতে হয়। দেখলে মনে হয় রক্ত নেই শরীরে। টান-টান হয়ে আছে ফর্সা চামড়া। হয়তো পুড়ে গিয়েছিল লোকটার শরীর। অন্য জায়গা থেকে চামড়া কেটে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে মুখে আর হাতে। ক্ষয়ে গেছে নাকের পাটা, ঠোঁটের কোনা। আঙুলে নখ নেই বললেই চলে। অমলের বুঝতে দেরি হলো না এই লোকই কামালের ভিআইপি কাস্টমার। মুখ খুলল অমল, ‘আপনি কি কামালকে খুঁজছেন?’
‘কামাল না জামাল সেটা বলতে পারব না। তবে এই বাক্স যার, তাকেই খুঁজছি,’ খসখসে গলায় উত্তর দিল সফেদ আগন্তুক।
‘এই বাক্স কামালের। জল আনতে গেছে। বসেন, এসে পড়বে এখনি।’
বেঞ্চে বসে লোকটা বলল, ‘আপনি কি কামালের আত্মীয়?’
‘জী-না। আমি ওর কাস্টমার। সত্যি বলতে কী আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’
‘আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন! ইন্টারেস্টিং। কী ব্যাপার বলেন তো?’
‘না তেমন কিছু না। মাথা বানাচ্ছিলাম ওকে দিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়। ও বলল লালমণির হাট। জানতে চেয়েছিলাম লালমণির হাটের নাম লালমণির হাট হলো কেন।’
‘ও, আচ্ছা। তো এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’
‘আছে, সম্পর্ক আছে। কামাল বলছিল, ও জানে না, তবে আপনি জানেন।
‘জানলেই বা কী? সে তো আমাকে চেনে না। এখানে কখন আসব তারও কোনও ঠিক নেই। আপনাকে বলল আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর জানি, আর আপনি কাজ-কাম ফেলে পার্কে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এ তো দেখি
‘আমার মন বলে তুমি আসবে…’ তাজ্জব ব্যাপার!’
‘আপনি যেরকম ভাবছেন বিষয়টা সেরকম নয় মোটেও। আমি এমনিতেই সময় কাটানোর জন্যে বেশ কিছুক্ষণ বসতাম এখানে। এরই ভেতর আপনি এসে পড়লেন। একে কাকতালীয় ছাড়া আর কী বলব?’
জল নিয়ে কামাল এসে পৌঁছাল। ভিআইপি কাস্টমারকে বেঞ্চের ওপর বসে থাকতে দেখে সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে গেল তার। বলল, ‘ছার, কহন আইলেন?’
‘এই তো এখনই। তুমি তো মনে হচ্ছে ব্যস্ত?’
‘কী যে বলেন, ছার? আফনের কাম সবতের আগে। মাথা বানাইবেন, ছার?’
‘না। আজ আর মাথা বানাতে হবে না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম পার্কে একটু বসি। তোমার কাজ তুমি করো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
‘ছার, এই সা’বে একটা কথা জানবার চায়। তারে কইছি আফনে কইবার পারবেন। উনারে জওয়াবটা দিয়া দেন। ছার, সওয়ালটা হইল, লালমণির হাটের নাম লালমণির হাট হইছে কেমনে?’
‘প্রশ্নের জবাব দিলে কি তুমি খুশি হবে?’
‘ছার, কাস্টমারগো খুশি হইল আমগো খুশি। তয়, ছার, আফনার অসুবিদা হইলে দরকার নাই। একজনরে খুশি করতে গিয়া দশজনরে অখুশি করন ঠিক না।’
‘এতদিন জানতাম নাপিতেরাই দার্শনিকের মত কথা বলে। এখন দেখছি কান পরিষ্কার করাঅলারাও ওই একই গুণের অধিকারী। কান টানলে মাথা আসে। মাথা নিয়েই যখন কারবার। দার্শনিক তো হতেই হবে। যা হোক, আমার অসুবিধা নেই। তবে উনাকে খুশি করার চেয়ে তুমি যাতে অখুশি না হও, সেইটে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আব্দার একটা যখন করেই ফেলেছ, তখন সেটা রাখব আমি। বলছি শোন। লালমণির হাটে আজ থেকে দেড় শ’ বছর আগে ইংরেজরা রেল লাইন বসিয়েছিল। এই রেল লাইন বসাতে গিয়ে শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ি। মাটি খুঁড়তেই পাওয়া গেল অসংখ্য লাল পাথর। এই লাল পাথরকেই ওখানকার লোকেরা বলত লাল মণি। হাটে নিয়ে গিয়ে বেচাও হতে লাগল পাথর। সেই থেকেই ওই জায়গার নাম হলো লালমণির হাট।’
কামাল অমলের দিকে তাকাল। মুখে দিগ্বিজয়ের হাসি। সেই হাসি কথায় ট্র্যানস্লেট করলে এই রকম দাঁড়াবে: দেখলেন তো! আফনারে কী বলছিলাম? ছার খুব শিক্ষিত।
আগন্তুক এইবার অমলের দিকে নজর দিল। তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আছেন কোথায়?’
‘না, তেমন কোথাও না।’
‘”তেমন কোথাও না’” বলতে?
‘এতদিন এক ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে ছিলাম। তবে এখন আর নেই। বেকারই বলতে পারেন।’
‘বেকারই বললে মনে হয় কিছু না কিছু কাজ-কর্ম আছে। আসলেই কি তা আছে?’
‘না, নেই। কোনও কাজই নেই। একেবারেই ঝাড়া হাত-পা। পুরো বেকার।’
‘হুঁ। তা আপনি পড়াশুনো কতদূর করেছেন, জানতে পারি?’
‘মানিকগঞ্জ কলেজ থেকে বি.কম. পাশ করেছি।’
‘বি.কম. তো ভালই। চাকরি তো হওয়ার কথা। সমস্যা কোথায়?’
‘চাকরি পেতে হলে পরিচিত লোক থাকতে হয়। না থাকলেও যে হয় না, তা না। তবে অ্যাকাউন্টসের কাজ। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিতে গেলে লাখ খানেক টাকা ডিপোজিট দিতে হয়। ওই টাকাটা জোগাড় করা যাচ্ছে না।
‘আপনার নাম কী, বলেন তো?’
‘আমার নাম অমল কান্তি।’
‘বিয়ে করেননি কেন? হিন্দু ছেলেরা বিয়েতে পণের টাকা পায়। ওই টাকায় সমস্যার সমাধান হতে পারত।’
‘বাড়িতে বিধবা মা আর ছোট-ছোট ভাই-বোন। এদের দেখাশুনোর ভার আমার ওপর। বিয়ে করে লেজে-গোবরে হতে চাইনি।’