সুলতানা বেগমও তাতে কোনও আপত্তি জানাননি। ভেবে দেখেন, সত্যিই তো একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে, বয়স্কা, অসুস্থ একজন মহিলার পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়। তাঁদের সঙ্গে থাকলে তাতে তো কোনও সমস্যা নেই। বরং সুলতানা বেগম তাঁর সমবয়সী একজন সঙ্গী পাবেন।
ঈশিতার মাকে নিয়ে সুলতানা বেগমদের চারজনের সংসার অত্যন্ত আনন্দেই কাটছে। ইয়াসমিন বেগম আর সুলতানা বেগম যেন মানিকজোড় হয়ে উঠেছেন। সারা দিনই দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া যায়। হয়তো গুটুর-গুটুর গল্প করছেন, নয়তো টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন। না হয় বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে একসঙ্গে চা পান করছেন। না হয় দু’জন মিলে নতুন কোনও আইটেম রান্না করছেন। অথবা পিঠা বানাচ্ছেন। না হয় দু’জন মিলে ঘর গোছাচ্ছেন। একসঙ্গে বাজার করতে চলে যাচ্ছেন। খাওয়ার সময়ও তাঁরা একসঙ্গে খেতে বসেন। একজনকে রেখে অন্যজন কখনওই খান না। রাতে ঘুমানও একসঙ্গে। অথচ দু’জনেরই আলাদা- আলাদা রুম আছে। তিনটি বেডরুমের একটি ঈশিতা আর সুমনের। অন্য দুটো তাঁদের দু’জনের।
সংসারের পুরো দায়িত্ব দুই বেয়ান ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। আর ঈশিতা শুধু মাত্র তাঁদের দু’জনের সাহায্যকারী হিসেবে পাশে থাকে। সুমনের দায়িত্ব শুধু সুবোধ বালকের মত আটটা-পাঁচটা অফিস করা। চারজন মিলে মিশে বেশ সুখেই আছে তারা।
প্রথম দেখায়ই সুলতানা বেগমের কাছে ইয়াসমিন বেগমের মুখটা খুব পরিচিত ঠেকেছিল। তখন তিনি ধরতে পারেননি অমন পরিচিত মনে হওয়ার কী কারণ। পরে ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা ধরে ফেলেন। ইয়াসমিন বেগমের চেহারার সঙ্গে সুলতানা বেগমের স্বামী আমজাদ হোসেনের চেহারার অনেক মিল রয়েছে। যেন এক মায়ের পেটের ভাই-বোন। শুধু ভাই-বোন বললেও ভুল হবে, যেন যমজ ভাই-বোন। দু’জনের চেহারায় যতটুকু পার্থক্য তা যেন একজন নারী, অন্যজন পুরুষ হওয়ায়।
সুলতানা বেগম তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইয়াসমিন বেগমের চেহারার মিল ধরার পর ভেবেছিলেন, হয়তো ইয়াসমিন বেগম তাঁর স্বামীর দিকের কোনও আত্মীয়া। লতায়-পাতায় পেঁচানো দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়াও তো হতে পারেন। সে কারণেই হয়তো তিনি চিনতে পারেননি। কিন্তু বিষয়টা সম্পর্কে ইয়াসমিন বেগমকে জিজ্ঞেস করে এবং তাঁর স্বামীর দুই ভাইয়ের কাছ থেকে এমন কোনও তথ্য পাননি যে ইয়াসমিন বেগম তাঁর স্বামীর দিকের কোনও আত্মীয়া। তবে ফটো অ্যালবামে আমজাদ হোসেনের ছবি দেখে ইয়াসমিন বেগম কেমন ভাবনায় ডুবে গিয়ে বলেছেন, এই লোকটিকে তিনি কোথায় যেন দেখেছেন। অনেকবার দেখেছেন। কিন্তু মনে করতে পারছেন না, কোথায় দেখেছেন।
চার
সন্ধ্যা হচ্ছে। চারদিকে শান্ত নীরবতা। সমস্ত আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে থমথম করছে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বোধহয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে।
গত কয়েক দিন ধরে খুব গরম পড়ছে। তীব্র তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। আকাশে কালো মেঘ জমতে দেখে সবার মনে এক ধরনের ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে।
সুলতানা বেগম আর ইয়াসমিন বেগম বারান্দায় বসে মেঘে ঢাকা আকাশ দেখতে-দেখতে চা পান করছেন। ইয়াসমিন বেগমের মুখটা মেঘে ঢাকা আকাশের মতই ভার হয়ে আছে।
সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেয়ান, আপনার মুখটা অমন ভার কেন? কোনও কারণে কি আপনার মন খারাপ?’
ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আকাশে মেঘ জমতে দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।’
সুলতানা বেগম অবাক গলায় বললেন, ‘আকাশে মেঘ জমেছে বলে আপনার মন খারাপ হবে কেন? তাতে তো মন আরও ভাল হয়ে যাবার কথা। কত দিন পর স্বস্তির বৃষ্টি আসছে।’
ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আকাশে মেঘ জমতে দেখলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হত না। ঝড়-বৃষ্টি মানেই গ্রামের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টির ঝম-ঝম শব্দ। উঠানে নেমে বৃষ্টি-স্নান। বাগানে আম কুড়াতে যাওয়া। পুকুরের পাড় বেয়ে উপরে উঠে আসা ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা। এসব কারণে মায়ের বকুনি শোনা। ঘরে ফিরে ভেজা কাপড় পাল্টে গরম ধোঁয়া ওঠা আদা চায়ের সঙ্গে ঝাল-ঝাল মুড়ি-চানাচুর ভর্তা খাওয়া। খিচুড়ির আয়োজন করা। আরও কত কী!’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘এখন তা হলে বৃষ্টি আসতে দেখে মন খারাপ করছেন কেন?’
‘একটা ঘটনার পর ঝড়-বৃষ্টি আমার কাছে অভিশাপ হয়ে গেছে।’
সুলতানা বেগম অবাক গলায় বললেন, ‘কী এমন ঘটনা! ঝড়-বৃষ্টিকে অভিশাপ মনে হবে কেন?’
‘এক ঝড়বৃষ্টির রাতের কথা। রাত দশটা-সোয়া দশটার মত বাজে। রাত দশটা-সোয়া দশটা মানেই গ্রামে অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে বছরই আমি এস. এস. সি. পাশ করেছিলাম। এস. এস. সি পাশের পর বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, আমি যেন আগের মত আর ঝড়-বৃষ্টি দেখলেই আম কুড়াতে না নেমে পড়ি। তাই বাবার ভয়ে দিনের বেলা আম কুড়াতে যেতে পারতাম না। ভাবলাম, সবাই যখন ঘুমিয়ে রয়েছে-এই সুযোগে আম কুড়াতে যাওয়া যায়। চুপি-চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। সে কী ঝড়-বৃষ্টি! বিকট শব্দে আশপাশে বাজ পড়ছে। একেকবার বাজ পড়ার শব্দে যেন পুরো পৃথিবী কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আমি সেই ঝড়-বৃষ্টির মাঝেই গুটি-গুটি পায়ে হেঁটে চলে যাই একটু দূরের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে। কারণ, ওই বাড়িতে অনেকগুলো বড়-বড় আমগাছ ছিল। অনেক আম পাওয়া যাবে ওখানে।