ওদিকে ড্রয়িং রুমে হিন্দি সিরিয়াল চলছে, ডাইনিং টেবিলে জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালার গবগব শব্দ। অমল কান্তির ভাই-বোন, বিধবা মা পাটুরিয়ায় গ্রামের বাড়িতে থাকে। আগে জমি-জমা ভালই ছিল। এখন পদ্মা ভেঙেচুরে সব শেষ করেছে, সেই সঙ্গে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে অমলের বাবাও। সংসার চালানোর দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। অফিস থেকে বেরিয়ে পীর ইয়ামেনী মাজারের কাছে ছোট পার্কে বসে গুলিস্তানের ট্র্যাফিক জ্যাম দেখতে দেখতে এখন কী করবে সেটি ভেবে কাহিল হয়ে যাচ্ছে অমল। ছোটাছুটি, হৈচৈ, কনুইয়ের গুঁতো, জামাই-বউ চানাচুর, আ- য়ে বুট-পালিশ, বাবা ভিক্ষা দেন-কত তাল! কে কার আগে যাবে, কীভাবে দু’টাকা পকেটে আসবে, সেই প্রচেষ্টা। অথচ সে কী করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। অমল লক্ষ করল, বেশ কিছুক্ষণ হয় চেংড়া এক ছেলে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। এর কাজ কানের ময়লা পরিষ্কার করা, মাথা বানানো। ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সে নানান উপকরণ। খাওয়া-পরার জন্যে মানুষ কত কী যে করে! লোকে চুল- দাড়ি কাটার বেলায় যত রেগুলার, কান পরিষ্কার করার বেলায় ততটা বোধ হয় না। চুল-দাড়ি বাইরে থেকে দেখা যায়। কানের ভেতর কী ছুঁচোর নেত্য হচ্ছে, বাইরে থেকে তো আর সেটা দেখা যায় না। পরিষ্কার করালেই কী, আর না করালেই কী? ময়লার ঠেলায় কান চুলকানো শুরু হলে তবেই না। ছেলেটার জন্যে অমলের মায়া হচ্ছে। এর হয়তো সকাল থেকে খদ্দেরই জোটেনি। এদের খদ্দেরদের যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, তাতে ছ’মাসে ন’মাসে একবারই হয়তো কান পরিষ্কার করাতে পারে। দুপুরে কী খাবে সেটা ভেবে হয়তো ভেতরে ভেতরে অস্থির কান পরিষ্কার করাঅলা। ছেলেটাকে ডেকে পাশে বসাল অমল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘কামাল।’
‘বাড়ি কোথায় তোমার?’
‘এত কথার কাম কী? কান পরিষ্কার করাইবেন, না মাথা বানাইবেন?’
‘মাথা বানাতে কত লাগবে?’
‘আদা গণ্টা দশ টাকা।’
‘আচ্ছা বানাও, মাথা বানাও। তবে ওই সব তেলফেল দিয়ো না। শুকনো-শুকনো মাথা বানাও। হাই অ্যাণ্ড ড্রাই।’
কামাল মাথা বানাতে শুরু করার পর অমল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কামাল, তোমার বাড়ি কোথায় তা তো বললে না।’
‘আমার বাড়ি কই জাইন্যা কী করবেন, সাব?’
‘কিছুই করব না। তবুও জানতে চাই। বলতে না চাইলে বাদ দাও।’
‘আমার বাড়ি লালমণির হাট।’
কামাল এখন চুল টানা বাদ দিয়ে দুই হাতের পাঞ্জা একসঙ্গে করে মাথায় হালকা বাড়ি দিচ্ছে। জোড়া জোড়া আঙুলের চটর-পটর শব্দ। ঘুমের আমেজ। দুশ্চিন্তার অবসান। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। ঘড়ি, মানিব্যাগ লোপাট হতে পারে।
‘আচ্ছা, কামাল, লালমণির হাটের নাম লালমণির হাট হলো কেন?’
‘এইটা তো, সা’ব, কইতে পারতাম না। তই এক সা’বে মনে লয় পারব।’
‘কোন্ সাহেব পারবে?’
‘মাজে মদ্যে এক সাব চাইরটার দিকে এই পার্কে আহে। হেই সা’ব খুব শিক্ষিত।’
‘সেই সাহেব খুব শিক্ষিত তা তুমি বুঝলে কী করে? তোমাকে কি সে বলেছে?’
‘এমনিই বুজা যায়। আফনে দেকলেও বুজবেন।’
‘সেই সাহেব এসে কী করে? তোমাকে দিয়ে মাথা বানায়?’
‘জী, আমি তার মাথা বানায়া দেই।’
‘এত শিক্ষিত লোক পার্কে বসে মাথা বানাবে কেন? সে মাথা বানাবে এসি সেলুনে। না হয় মাসাজ পার্লারে।’ ^
‘হেইডা তো, সা’ব, কইতে পারতাম না। আমি উনারে কোনও দিন জিগাই নাই।’
‘জিজ্ঞেস করনি কেন?’
‘ওস্তাদের নিষেধ আছে। বড় কাস্টমাররে কোনও কিছু জিগাইতে নাই।’
‘সে বড় কাস্টমার হলো কীভাবে?’
‘সা’বে একবার মাথা বানাইলে এক শ’ টাকা দেয়।’
‘এক শ’ টাকা দেয় পার্কে বসে মাথা বানানোর জন্যে! আজব লোক তো রে, ভাই। আজকে আসবে নাকি?’
‘হেইডা তো, সা’ব, কওন যায় না। আইতেও পারে, আবার না-ও আইতে পারে।’
‘কতদিন ধরে এখানে আসছে সে?’
‘তা ধরেন এক মাস হইব।’
‘এই এক মাসে ক’বার এসেছে ওই লোক?’
‘ছয়-সাতবারের মত।’
‘যদি সাতবার হয়, তা হলে সে এসেছে প্রতি চার দিনে একবার। শেষবার কবে এসেছিল?’
‘দুই দিন আগে।’
‘রুটিনমাফিক এলে আরও দু’দিন পরে আসার কথা, ঠিক না?’
‘জী, ঠিক। তয় আইজ মনে লয় আয়া পড়ব। ঘড়িত্ এখন বাজে কয়টা?’
‘সাড়ে তিন।’
‘আদা গণ্টা বহেন। আইলে লুকটারে দেকতে পারবেন।’
বসা ছাড়া অমল কান্তির আর কাজ কী? কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।
শ’খানেক চিনে বাদাম কিনে বেঞ্চে বসে অমল আর কামাল বাদাম খেল। বাদাম খেয়ে গলা গেল শুকিয়ে। জলের জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘোরাঘুরি করা জলঅলাকে খুঁজতে গেল কামাল। অমলের পাশে বেঞ্চের ওপর তার কাঠের বাক্স। এই বাক্স কামালের ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। সে যে- পেশার লোক, তার পরিচয় বহন করে ওটা। যেমন ধুনকারের ধুনুরি, নাপিতের ক্ষুর-কেঁচি-আয়না, ডাক্তারের কালো চামড়ার ব্যাগ, ছুরি-চাকু ধারদেয়াঅলার শান দেয়া মেশিন, শিল-পাটা-কোটাঅলাদের ছেনি-হাতুড়ি, উকিলের- মুহুরির ডায়েরি। এইসব ‘দক্ষ’ পেশাজীবীদের সবাই পুরুষ। মেয়েদের ভেতর কেবল বেদেনীরাই ঝোলার ভেতর ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। মফস্বল শহরে বেদেনীদের রমরমা ব্যবসার জায়গা হলো কোর্ট প্রাঙ্গণে বটগাছের তলা। পিঠ বের করা ছোট-ছোট ঘটি হাতা ব্লাউজ, ছাপা শাড়ির নিচ দিয়ে সেমিজের কুচি বেরিয়ে আছে, পাড়ে ঢাকা ভারী নিতম্ব, গোলাপি স্যাণ্ডেল, পায়ের বর্তুলাকার আঙুলে হালকা দেবে যাওয়া নিখুঁত কাটা নখে গাঢ় লাল নেলপালিশ, চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা চুল, পানের রসে লাল ঠোঁট, গোল গোল মসৃণ হাত ভর্তি চুড়ি, রোদে পোড়া লালচে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য। কোর্টে যারা আসে, তাদের সিংহভাগ গ্রামের খেটে খাওয়া মাঝবয়সী মানুষ। বছর-বছর ছেলেমেয়ে হওয়াতে এদের বউরা কাহিল। বেদেনীদের আঁটসাঁট দেহ, চিরল দাঁতের হাসি, ঘাম আর চুলের সুগন্ধ এক বড় ধরনের ডাইভারশান। মেয়েগুলোর কাছাকাছি বসে নানান অসুখ-বিসুখের আলোচনা করলে এদের মনটা অন্তত হালকা হয়। সে বেদেনীর ওষুধে অসুখ ভাল হোক, আর না হোক। কোর্ট এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর জায়গা, দয়া-দাক্ষিণ্য, মায়াকাড়া ব্যবহার এখানে নেই। তবে বেদেনীদের আছে। বেদেনীরা যখন কথা বলে, তখন তাদের সামনে বসা মাঝবয়সী লোকগুলো এমনভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন খ্রিস্টের বাণী শুনছে। আসলে আদৌ কিছু শুনছে কি না সেটাই প্রশ্ন। বেদেনী নিজেও সেটা ভালভাবেই জানে। তার অভিজ্ঞতাও কম নয়। কথা দিয়ে আর নানান ঢঙ-ঢাঙ করে এসব লোকেদের মুগ্ধ করাই তার কাজ। তার সাফল্য যতখানি ওষুধে, তার থেকে ঢের বেশি কথায়। কোর্টের উকিল, মুহুরি, পেশকার, বেইলিফদের টাকা দেয়ার পর বাস ভাড়া, দুপুরে খাওয়ার টাকা মাইনাস করে যা থাকে, তার বেশ খানিকটা যায় বেদেনীদের হাতে। অডেসি-র সাইরেনরাও মেয়ে ছিল। তবে পুরো মেয়ে নয়। উপরের অর্ধেক মেয়ে, নিচের অর্ধেক পাখি। সাইরেনদের গলা ছিল সাবিনা ইয়াসমিনের থেকেও বেশি মিষ্টি। একবার এদের গলার গান শুনলে ভুল হয়ে যেত দুনিয়াদারি। সাইরেনদের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে থাকত পুরুষেরা। তারপর যেত ওদের পেটে। বেদেনীরা সাইরেন নয়। তাদের মায়া-দয়া আছে। টাকা-পয়সা হয়তো কিছু নেয়, তবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আর চোখ-মুখ নেড়ে মন তো রাঙায়। মেয়েদের সঙ্গ যে কত মধুর হতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই বেদেনীরা। নিজেদের স্বামীদের সঙ্গে বেদেনীরা এরকম মিষ্টি ব্যবহার করে কি না, কে জানে? তবে নিজ গৃহে খাণ্ডারনী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।