রাত এগারোটার দিকে লোকজন খবর দিয়ে এনে ফুপুকে খোঁজা শুরু হয়। সারা জঙ্গল জুড়ে জ্বলতে থাকে মশালের আলো। একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক আর একেকজনের হাতে বনবিভাগের সংরক্ষিত মশালের জ্বলন্ত আগুন। এক অন্যরকম পরিবেশ।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে জঙ্গলের পশ্চিম দিকের ডোবার পাশে বড় ফুপুকে পাওয়া যায় অচেতন অবস্থায়। অক্ষত শরীরের অর্ধেক ডোবার পানিতে আর অর্ধেক ডাঙায়। পরনে শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট। আশপাশে কোথাও খুঁজে ফুপুর শাড়ি পাওয়া গেল না।
সেদিনের পর থেকে আমার বড় ফুপুর মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় রাতেই নাকি ফুপু দেখত তার শরীরের উপর বিশাল এক জানোয়ার বসে আছে। জানোয়ারটির সারা শরীর লোমে ঢাকা। কত রাত ভয়ে দরজা খুলে ফুপু জ্ঞানশূন্য হয়ে কোথায় চলে গেছে! আবার সবাই মিলে জঙ্গল থেকে ফুপুকে খুঁজে এনেছে। সমস্যা চলতে থাকল বড় ফুপুর। কিন্তু এর দায় মেটাতে হলো ফুপাকে। একদিন রাতে জঙ্গলে ফুপুকে খুঁজতে গিয়ে ফুপাও ফিরে এলেন না। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা ভোরের দিকে ফুপুকে পেলেন সেই ডোবার ধারে। আর ফুপাকে পেলেন ডোবা থেকে একটু দূরে মৃত অবস্থায়। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা এর আগে কোনদিন সেখানে ঘটেনি। ফুপার সারা গায়ে ছিল নখের আঁচড় আর কামড়ানোর দাগ। বনবিভাগের কর্মকর্তারা এখানে এ যাবৎকালে এমন কোন প্রাণী দেখেননি যেটা এভাবে কোন ঘটনা ঘটাতে পারে। আবার এ ঘটনাকে পুরোপুরি ভৌতিকও বলা যায় না। প্রথমত অনেকের ভূতে বিশ্বাস নেই। তার ওপর কোন ভূত এমন ঘটনা ঘটায়, এমন কিছু কেউ দেখেনি। বড় ফুপুর বিবাহিত জীবনে ভারতের জঙ্গলে বসবাসের গল্প এখানেই শেষ। এমনটিই শুনেছি।
তারপর থেকে বড় ফুপু চলে আসে আমাদের বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও বড় ফুপুকে আবার বিয়ে করতে রাজি করাতে পারেনি কেউ। কিছুদিন পরপর রাতের সেই সমস্যা আর আত্মহত্যা করার সমস্যা ছাড়া তেমন কিছু উল্লেখ করার মত ঘটেনি। মাঝে-মাঝে যদিও উন্মাদের মত আচরণ করে ফুপু, সেটা খুব কম।
তিন মাস হয়ে গেল আমরা কেউ বড় ফুপুকে এক নজর দেখিনি। রুমের সব ছোটখাট ফাঁকফোকর ফুপু বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই কর্তবার গিয়ে বড় ফুপুকে অনুরোধ করে। ফুপু শুধু খসখসে গলায় বলে, ‘তোমরা যাও। আমি আর এখন তোমাদের কেউ না।’
জমেলা খালা একদিন জানালায় ভাত রেখে আসতে গিয়ে খুব বড় রকম ভয় পেয়ে গেল। ঘটনা কী জানতে চাইলে জমেলা খালা হেঁচকি টানতে-টানতে বলে, সে নাকি জানালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখেছে ঘরের মধ্যে তিনটে জানোয়ার। একটা ছোট আর দুটো বড়। আজীবন জমেলা খালার বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘জানোয়ার-জানোয়ার করছেন কেন? জানোয়ার মানে কী?’
জমেলা খালা তারপরও কাঁদতে-কাঁদতে বলে, ‘কুত্তার মত দেখতে। তিনটা কুত্তা। ও, আল্লা, এইডা তুমার কীয়ের গজব!’
এতদিনে ফুপুর সমস্যা অনেক আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী জেনে গেছে। প্রায় দিনই কেউ না কেউ বাড়িতে আসছেই। কোন লাভ নেই। কারও সঙ্গেই ফুপু দেখা করে না। একদিন আমি টানা এক ঘণ্টা ফুপুর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদি ফুপু আমার সঙ্গে একটু দেখা করে। কোন লাভ হলো না। শুধু জানালার ওপাশ থেকে ফুপু ফিসফিস করে ঠিক আগের মত বলল, ‘বাবু, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে। জোড় হাত করে বলি আমার উপর রাগ রাখিস না।’
আমিও ফুপুর মত ফিসফিস করে বললাম, ‘প্লিজ, ফুপু, আমার খুব কষ্ট লাগছে। দরজা খোলেন। খুব ইচ্ছা হচ্ছে আপনাকে একবার দেখি।’
‘আমাকে দেখলে তুই খুব ভয় পাবি, বাবু। আমি আর আগের মত নাই।’
আমার এত খারাপ লাগল! আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। কণা আপা এগিয়ে এসে খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কাঁদিস না, বাবু। কাল দাদী বড় হুজুরের দেয়া তাবিজ ফুপুকে পরাবে। বড় হুজুর বলেছে তাবিজ নেয়ার সাত ঘণ্টার মধ্যে ফুপু ভাল হওয়া শুরু করবে। দেখিস বড় ফুপু ভাল হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না, ভাই।’
শুক্রবার সকাল বেলা ফুপুকে আমি নিজ হাতে জানালায় তাবিজটা দিয়ে এলাম। ফুপু কথা দিল তাবিজটা ডান কোমরে ঝুলিয়ে পরে নেবে। আমি বিকেল থেকেই বুক ভরা আশা নিয়ে ফুপুর দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে লাগলাম।
রাত দশটা মত হবে। এখনও ফুপুর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আমি দরজা ধাক্কাতে যাব, ঠিক তখনই জমেলা খালার আর্তচিৎকার। তার ভয়ার্ত চিৎকারে বাড়ির সবাই গিয়ে দেখি কলপাড়ের পাশে ঝোপমত জায়গায় জমেলা খালা রক্তশূন্য মুখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। বাবা আশপাশে টর্চ মারতেই আমার শরীর হিম হয়ে গেল। দেখলাম মানুষের মত মুখ, আর গরিলার মত শরীর নিয়ে তিনটা প্রাণী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। একটি বড়, একটি মাঝারি, একটি ছোট। যেন একটি মৃত পরিবার। সারা গায়ে লোম। ঘন কালো বড়-বড় লোম। আমি বাবার হাত থেকে টর্চ লাইট নিয়ে আলো ফেলে দেখলাম পশুগুলোকে। মাঝারি আকারের পশুটার মুখে আলো ফেলে চমকে গেলাম। দেখলাম ওটা আমার বড় ফুপু।
কালো জাদু – মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর
এক
অনেক চেষ্টা করেও অমল কান্তি ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকরিটা বাঁচাতে পারল না। পরপর তিন মাস হলো টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। তার বেতন আসে গ্রাহকদের প্রিমিয়াম থেকে। তিন মাসে গ্রাহক জোগাড় করতে পেরেছে মাত্র পাঁচজন। সেই পাঁচজনও এমন কোনও বড় পার্টি না, নিজের পরিচিতদের মধ্য থেকেই ধরে বেঁধে রাজি করিয়েছিল। এরা প্রথম দু’মাস প্রিমিয়াম জমা দিয়েছে, তৃতীয় মাসে প্রিমিয়ামের খবর নেই। দেখা করতে গেলে কাজের মহিলা দরজা খুলে বলে, ‘সাহেব, মেম সাহেব কেউ ‘বাসাত’ নাই।’