জমেলা খালা কাঁদো-কাঁদো মুখ করে আমার দিকে তাকাল। নিমেষেই খালার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এবং আমার সাহস জোরাল করতেই বোধহয় ঠিক তখনই বাড়ির সবাই চলে এল। আমাকে কিছু বলতে হলো না। মাকে দেখেই জমেলা খালা এক চিৎকার দিয়ে সব খুলে বলল। সম্ভবত বড় ফুপু মারা গেছে কেউ বিশ্বাস করল না। বাবা এক দৌড়ে আমার রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ছেলেমানুষের মত বাবা কাঁদছে দেখে কণা আপা আর মা-ও কাঁদতে শুরু করল। সম্ভবত এখন থেকে শুরু হলো মৃত বাড়ির মত পরিবেশ।
পাশের বাসার আনোয়ার চাচা এসে অকারণে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করলেন। অমুক করো, তমুক করো, পুলিসে খবর দাও আরও কত কী। বাবা, আমি আর আনোয়ার চাচা মিলে ফুপুর লাশ বের করার জন্য চেষ্টা করছি, তখন খাটের নিচ থেকে গড়াগড়ি দিয়ে বাইরে এসে ফুপু বলল, ‘বাবু, বিষটা মনে হয় দুই নম্বর ছিল। কতক্ষণ ধরে মরার জন্য শুয়ে আছি! ওয়াক থুহ্।’
আমার বড় ফুপুর পাগলামির ধরন ঠিক এমনই। কিছুদিন পুরো সুস্থ মানুষ। হঠাৎ-হঠাৎ আবার পাগলামি। দাদী কতরকম কবিরাজের কাছ থেকে কতরকম তাবিজ এনে ফুপুর গলায় পরিয়ে দিল, কিছুতেই বড় ফুপু সুস্থ হয় না। তাবিজের সংখ্যা যখন বারো-তেরোটা, তখন একদিন সবগুলো তাবিজ গলা থেকে খুলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে কোথায় যেন ফেলে দিল বড় ফুপু।
বিষ খাওয়ার পর থেকে বড় ফুপুর সমস্যা দিন-দিন বাড়তে লাগল। প্রায় রাতেই বড় ফুপু সবাইকে চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। গত শুক্রবারের কথা। রাত প্রায় দেড়টার দিকে পাড়া কাঁপানো শব্দে ফুপু চেঁচাতে লাগল। আমি বিছানায় শুয়ে কান পেতে শুনলাম ফুপু ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে আর বলছে, ‘ও, মা, আমারে বাঁচাও। এই শুয়োরের বাচ্চারে এইখান থেকে যাইতে কও। ও, মা, ও, মা, ও, বাবু, আমারে বাঁচা।’
আমি গিয়ে দেখলাম ফুপুর রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বাবা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘেমে গেছে। দাদী বারান্দার মেঝেতে বসে কাঁদছে আর মা কণা আপার পাশে ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার শত অনুরোধেও ফুপু দরজা খুলল না। আমি এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে বললাম, ‘বড় ফুপু, আমি বাবু। প্লিজ, দরজা খোলেন।
বড় ফুপু রাজি হলো। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আমি আর কণা আপা ছাড়া রুমে কেউ ঢুকতে পারবে না। আর এখন থেকে আমি আর কণা আপা ছাড়া এই বাড়ির আর কারও সঙ্গে ফুপু দেখা করবে না। সবাইকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর আপা ফুপুর ঘরে ঢুকলাম। সব কিছু লণ্ডভণ্ড। বিছানার চাদরের নিচে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। সারা চাদর ভরা রক্ত। অথচ ফুপুর শরীরের কোথাও আঘাত লেগে কেটে- ছড়ে যায়নি। কণা আপা ফুপুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনার রুমে কে এসেছিল, বড় ফুপু?’
বড় ফুপু আবার কাঁদতে শুরু করল। বলল, ‘বিরাট একটা জানোয়ার। সারা গায়ে বড়-বড় ঘন কালো লোম। আমারে শেষ করে দিল। ওই শুয়োরটা আমারে বাঁচতে দিবে না।
আমি আর কণা আপা সে রাতে ফুপুর সঙ্গে ঘুমালাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফুপু উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আর ফুপুর পিঠ ঘন কালো বড়-বড় লোমে ছেয়ে গেছে। আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। হায়, খোদা, এসব কী দেখছি আমরা!
বড় ফুপুর শত নিষেধ সত্ত্বেও ব্যাপারটা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিলাম। কিন্তু বাবার কথামত বাড়ির কয়েকজন ছাড়া যেন বাইরের কেউ এসব জানতে না পারে এ ব্যাপারে সবাই সচেষ্ট থাকলাম। কারণ এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিদিন বাড়িতে লোক আসতে থাকবে। মিডিয়ার লোক এসে বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বানিয়ে দেবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
দিন পার হয় আর বড় ফুপুর ঘরে আত্মগোপনের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। এতদিন আমি ফুপুর ঘরে যেতে পারতাম। কিন্তু ইদানীং ফুপু আমাকে তার ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। জানালা দিয়ে খাবার রেখে আসা হয়। বড় ফুপু কোন উচ্চবাচ্য করে না। লক্ষ্মীর মত খাবার খায়। তারপর চুপ করে ঘুমিয়ে যায়। আর দাদীর জোগাড় করা বিভিন্ন সাইজের তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রাখে।
বাবার বোনদের মধ্যে বড় বলে আমরা এই ফুপুকে বড় ফুপু বলে ডাকি। বড় ফুপুর বয়স চল্লিশের একটু বেশি হবে। সবার মুখেই শুনেছি, ফুপুর এমন অবস্থা আগে ছিল না। ফুপুর বয়স যখন আঠারো-উনিশ, তখন ফুপুর বিয়ে দেয়া হয়। দাদী আর বড় ফুপুর কাছে যেমনটা শুনেছি, তাতে গল্পটা ছোট্ট করে এভাবে বলা যায়-
ভারতে বসবাসরত সুলতান নামে এক ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে ফুপুর বিয়ে হয়। সুলতান নামের লোকটি আমার এই অপরূপা ফুপুকে নিয়ে যান ভারতে। সেখানে ফুপুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসবাস করতে নিয়ে যান মাত্র দুটি ফ্যামিলি থাকে বনবিভাগের এমন এক কোয়ার্টারে।। চারপাশে জঙ্গল আর মাঝখানে মাত্র সাতজনের বসতি। ফুপু নাকি জঙ্গলের মাঝখানে থাকতে একদম পছন্দ করত না। সারাদিন-সারারাত ঘরের মধ্যে থাকা ফুপু একদিন সন্ধ্যায় একাই ঘুরতে বেরোয় জঙ্গলে। ঠিক কী কারণে ফুপুর যেন সাহস, অনেক বেড়ে যায় সেদিন। চারপাশে সারি-সারি গাছের ঘন বন আর বুনোফুলের গন্ধভরা সরু একটি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড় ফুপু গহীন বনে চলে যায়। আকাশে তখন হালকা চাঁদের আলো।
অন্যান্য দিন ফুপা সন্ধ্যার পরপর অফিস থেকে বাসায় ফিরে ফুপুকে রুমে পান। কিন্তু সেদিন ফুপুকে তিনি না পেয়ে দক্ষিণের রুমে থাকা আরেক কর্মকর্তার রুমে গিয়ে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারেন না। বড় ফুপা সত্যি-সত্যি অবাক হন, সঙ্গে কিছুটা আতঙ্কিতও। যে জঙ্গলের ভয়ে সারাদিন রুমে থাকে, সে এতরাত অবধি কোথায় থাকবে? রাত বাড়তে থাকে, তবু ফুপু ফিরে আসে না। দাদীর মুখে শুনেছি, ফুপু ফিরে আসছে না এই দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে ফুপা নাকি সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন।