.
দুপুর একটা বাজে।
আশ্রাফ আলী মেমোরিয়াল হাসপাতালের গেটে এসে থামল একটা রিক্সা। ওটা থেকে নামল স্কুল ফেরত ক্লাস ফোরের ছাত্র আশ্রাফ মাজিদ। তাকে দেখে অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার জয়গুন ছুটে গেল গেটের দিকে।
ছেলেকে কোলে করে হাসপাতাল কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল ডাক্তার জয়গুন। এখন স্বামী, সংসার আর ছোট আশ্রাফ ও এই হাসপাতালকে ঘিরেই সুখে কেটে যাচ্ছে তার জীবন।
রোমশ – নাসির খান
‘বাবু, আজ বাসায় কেউ নেই। আত্মহত্যা করবার জন্য আজকের থেকে ভাল কোন দিন পাব বলে মনে হয় না। কি বলিস? বাবু, তুই তো জানিস গলায় দড়ি দিতে আমি খুব ভয় পাই। তা ছাড়া এটা লজ্জারও। দেখা গেল কোন না কোনভাবে তোরা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছিস, তখন আমার গলায় গোলাকার একটা ঘায়ের মালা হয়ে থাকবে, যে ঘায়ের মালায় মৌমাছির বদলে মাছি ঘোরাঘুরি করবে। তা ছাড়া আমি চাই না কেউ দেখুক আমি মা কালীর মত জিভ বের করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছি। তাই তোর খাটের নিচে রাখা ইঁদুর মারা বিষ খেলাম আর হ্যাঁ, আমার লাশ তোর ঘরে খাটের নিচেই পাবি। আমার উপর রাগ রাখিস না। ইতি-তোর বড় ফুপু।’
ঘরে ঢোকার আগেই জমেলা খালা চিঠিটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আফায় দিছে। কইল তুই ঘরে ঢুকার আগেই যেন তোর হাতে দেই। কাহিনী কী, মামা? ‘
কাহিনী জমেলা খালাকে বলা প্রয়োজন মনে করলাম না। কারণ চিঠি পড়ে উদ্বিগ্ন হবার মত কিছু নেই। আমার বড় ফুপুর মাথায় সমস্যা। সমস্যা বলতে বিরাট সমস্যা। পাবনায় গিয়ে পাগলাগারদে ভর্তি করানোর মত সমস্যা। এমন ঘটনা এর আগে আরও দু’বার হয়েছে। আরও দু’বার বড় ফুপু সুইসাইড নোট লিখে রেখে দিয়েছিল বাবার জামার পকেটে। তার মধ্যে একবার ফুপু ছাদের চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল। আরেকবার বাড়ির পিছন দিকের জঙ্গলের শেষের দিকটার ডোবায় একহাঁটু কাদা মাখামাখি হয়ে হাতিয়ে মাছ ধরছিল। সেদিন ভর দুপুর বেলায় খুঁজতে- খুঁজতে ডোবার পাশে গিয়ে দেখি শুধুমাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে কাদার মধ্যে বড় ফুপু দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ইয়াবড় একটি কালো কুচকুচে মাছ। আমি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ফুপুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় ফুপু! আপনি মারা যাননি?’
আমার প্রশ্নে খুব বিরক্ত হয়ে বড় ফুপু আমার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলল, ‘না, মরিনি। তোর কোন সমস্যা? মাছ খাবি? ওইখানে দেখ কাপড় ভরা মাছ।’
আমি অবাক হয়ে দেখলাম ডোবার পাশে রাখা বড় ফুপুর কাপড় ভর্তি মাছ। এত মাছ বড় ফুপু হাত দিয়ে ধরেছে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি ফুপুকে জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই ডোবা থেকে উঠে এসে, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, দুনিয়া কাঁপানো একটি চড় দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে দিল ফুপু।
তাই এমন ঘটনা ঘটানো বড় ফুপুর সুইসাইড নোটে আমাদের তেমন কোন বিকার নেই। হয়তো কোথাও লুকিয়ে
আছে বড় ফুপু। আমরা যখন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাব, তখন কোন এক জায়গা থেকে বেরিয়ে ফুপু বলবে, ‘দেখলি তো, বাবু, আমি কী সুন্দর অভিনয় করতে পারি!’
মা-বাবা, দাদী, কণা আপা কেউ বাসায় নেই সকাল থেকে। ভবানীপুরে কোথায় নাকি নতুন মাজার শরীফের সন্ধান মিলেছে। তাই পুরো পরিবার গিয়েছে সওয়াব আদায় করতে। বাবা, মা আর দাদীর বুদ্ধি সম্পর্কে আমার জানা আছে। কিন্তু কণা আপা কী মনে করে মাজারে গেল কে জানে।
বাড়ির সবার রুম বাইরে থেকে তালা দেয়া। কেবল আমার আর বড় ফুপুর রুম বাদে। বড় ফুপুর রুমে ঢুকে দেখি কেউ নেই। ফাঁকা রুম। ভর দুপুরে ফুপু কখনও নিজের রুম ছাড়া বাইরে থাকে না। জমেলা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খালা, ফুপু তো রুমে নাই। কোথায়, জানেন?’
উত্তর নেতিবাচক।
জমেলা খালা সকাল থেকেই নাকি কাপড় ধোয়া আর খড়ি কাটায় ব্যস্ত। বড় ফুপুর খোঁজ রাখার সময় তার নেই। অথচ এখন যদি টিভি ছেড়ে দিই, তার কোন কাজ থাকবে না। সোজা মেঝেতে গেড়ে বসে চলচ্চিত্র সম্পর্কে একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দিতে শুরু করবে। ‘এই নায়িকার গায়ে গোশ্ত নাই। এমন চিংড়ি মাছ নায়িকা হয় ক্যামনে?’
শুধু এই না। নায়িকার দুঃখের সিকোয়েন্সে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে চোখের জল ঝরায় সে আমাদের জমেলা খালা।
আমার রুমে এসে কী মনে হতে একবার খাটের নিচে উঁকি দিয়ে চমকে গেলাম। বড় ফুপু শুয়ে আছে। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পরা। মুখ দিয়ে ঘন সাদা ফেনা গড়াচ্ছে। দু’একটি মাছিও ওড়াউড়ি করছে। আমার বুক কেঁপে উঠল। বড় ফুপু সত্যি বিষ খেয়েছে। পাশেই ইঁদুর মারা বিষের প্যাকেট। ঘটনার অবিশ্বাস্যতা আর আকস্মিকতা এমন পর্যায়ে যে আমি কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। বাইরে থেকে খাটের নিচে হাত বাড়িয়ে দু’তিনবার ফুপুকে নাড়াচাড়া দিয়ে ডাকলাম। নিশ্চিত হলাম ফুপু সত্যি মারা গেছে।
আমি ছেলেটা একটু আলাদা। যে কোন কিছুতে নির্বিকার থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা আমার কাছে কোন ব্যাপার না। শুধু মনে-মনে কয়েকবার বলি, ‘যা হবার সেটা হয়েই গেছে। এখন আর কিছু করার নেই। মাথা কুটে কোন লাভ নেই।’ এই লাভের হিসাব গুনতে গুনতে কলপাড়ে এসে জমেলা খালাকে বললাম, ‘জমেলা খালা, বড় ফুপু মারা গেছে। আমার খাটের নিচে লাশ পড়ে আছে।’