সবাই আগেভাগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিল। হাশেম কবিরাজ রাতে হুক্কা খায়। সে হুক্কা জ্বেলে গুড়-গুড় করে টেনে চলেছে।
ঠিক এ সময়ে প্রচণ্ড শব্দ হলো টিনের চালে। পরক্ষণেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
কাজেম দরজা খুলতে চাইলে আশ্রাফ আলী তাকে বাধা দিয়ে নিজে গিয়ে খুলে দিল দরজাটা।
দরজায় রক্তাভ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হামিদা ও সুখরান।
‘তোমরা!’
‘আমাদের তো আসারই কথা ছিল। কিন্তু তুই এর মধ্যে কথার খেলাফ করে ফেললি।’ হামিদা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো। তার পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকল সুখরান।
ঘরে ঢুকেই প্রথমে ওদের চোখ পড়ল হাশেম কবিরাজের উপর। মেঝেতে চট বিছিয়ে বসে আছে তার জিনিসপত্র নিয়ে।
‘হাশেম! তুই এইসব করাইলি রে! তুই এইসব করাইলি!’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল হামিদা। আক্রোশে ফেটে পড়ছে সে।
‘তোরা ওর ক্ষতি করতি। তাই ওরে বাঁচাইলাম। ও আমাদের মেয়ে।’ হাশেম কবিরাজ হুক্কা থেকে মুখ তুলে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল কথাটা।
‘ও তোদের মেয়ে কীসের! ও পরীর মেয়ে। আমরা ওর বিয়ে ঠিক করেছি। পাত্রও বাইরে আছে। এবার তার মোকাবেলা করিস।’ সুখরান পারে তো হাশেম কবিরাজকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
‘তোরা চুপচাপ চলে যা। কোনও সমস্যা করলে বোনঝির সাথে তোদেরকেও আজীবন আমাদের সাথে আটকে রাখব।’ হাশেম কবিরাজ তার জিনিসপত্র দেখে নিয়ে বলল কথাটা।
এই কথা, হারামজাদা! তোর বাপ আসছে! পারলে রাখ! হামহাম, ভেতরে আয়!’ হামিদা গর্জে উঠল।
কথাটা বলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল দুই বোন। ঠিক তখুনি গর্জাতে গর্জাতে সাত ফুট লম্বা এক রাক্ষস ঢুকল ঘরে। সন্ধ্যার পর পরই হাশেম কবিরাজ সবাইকে রক্ষাকবচ গলায় পরতে ও পবিত্র পানি দিয়ে শরীর মুছে নিতে বলেছিল। এই রক্ষাকবচের জন্য কোনও অপশক্তি তাদের কারও ক্ষতি করতে পারবে না। পারার কথাও নয়। কুৎসিতদর্শন রাক্ষসটাকে দেখে আতঙ্কিত হলেও নিজেদেরকে সামলে নিল সবাই।
রাক্ষসটা ঘরে ঢুকে কঠিন এক গর্জন ছাড়ল। এতে জয়গুন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাজিদের পাশে। হামহাম নামের সেই কুৎসিত রাক্ষস চাইল হাশেম কবিরাজের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু অদৃশ্য এক শক্তিতে বাধা পেল সে। চিৎকার করে উঠল। হাশেম কবিরাজ তার সামনে রাখা বিভিন্ন উপাদান নিয়ে ছুঁড়ে মারল দুই পরীর দিকে। এবার রাক্ষসটাকে মারবার আগেই ক্ষিপ্ত হামহাম তার হাত চালিয়ে আশ্রাফ আলীকে নাগালে পেয়ে পেল।
সন্ধ্যার পর আশ্রাফ আলী তার রক্ষাকবচ খুলে বাথরুমে গিয়েছিল। পরে ফিরে আর তা গলায় দিতে ভুলে গেছে। এ কারণে হামহাম রাক্ষস তাকে ধরতেই পারে। আর ধরতে পেরেই উল্লাসে ফেটে পড়ল সে। হাশেম কবিরাজ খুলবুল শেকড় ছুঁড়ে মারার আগেই ভাঙা পুতুলের মত করে আশ্রাফ আলীকে ঘরের চালায় ছুঁড়ে মারল রাক্ষস।
চোখের পলকে পেঁজা তুলার মত উড়ে গেছে আশ্রাফ আলী।
ঘরের মানুষগুলো ভয়ে ঢেকে ফেলল চোখ। মুহূর্তে বলের মত চালে বাধা পেয়ে সশব্দে মাটিতে পড়ল আশ্রাফ আলীর ভারী দেহ। পড়ামাত্রই নিথর হয়ে গেল সে। কারও কল্পনাতেই ছিল না এমনটা ঘটবে। এবার তার সামনে রাখা বড় একটা হাঁড়ি থেকে নিয়ে দুই পরীকে লক্ষ্য করে মন্ত্রপূত তেল ছুঁড়ে মারল হাশেম কবিরাজ। সেই তেল গায়ে পড়ামাত্র তাদের দু’জনের শরীরে জ্বলে উঠল আগুন। বিকট স্বরে চিৎকার ছাড়ল হামিদা ও সুখরান। ভোজবাজির মত আস্তে আস্তে আকারে ছোট হতে থাকল তাদের দুটো দেহ।
এরপর হাশেম কবিরাজ সেই একই তেল হামহামের দিকেও ছুঁড়ে মারল। দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল রাক্ষসটা। তারপর একইভাবে আকারে ছোট হতে লাগল সে।
অন্য একটা পাত্র থেকে অষ্টধাতুর মিশ্রণ তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারল হাশেম কবিরাজ। এবার অষ্টধাতুর স্পর্শ লাগতেই নিভে গেল তাদের শরীরের আগুন। আকারে ছোট হতে শুরু করে ধীরে ধীরে বিড়াল ছানায় রূপ নিল দুই পরী। আর রাক্ষস হামহাম হয়ে উঠল একটা কুকুর। সবার সামনে দুই বিড়াল ছানাকে দাবড়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেল কুকুরটা।
অবশ্য এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থাকল শুধুমাত্র কাজেম ও কবিরাজ। কারণ জয়গুনের মত আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ময়না। আর মাজিদ চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল ভয়ে। যত যাই হোক, ক্লাস টেনে পড়া পনেরো বছরের বালক সে।
পরদিন ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান সেরে মাটি দেয়া হলো আশ্রাফ আলীকে। এরপর পরীর মেয়ে জয়গুনকে নিয়ে আর কোনও সমস্যা হয়নি। বাবার মৃত্যুতে কাজেম খুব মর্মাহত হলেও এটাকে একটা দুর্ঘটনা ভেবে মেনে নিয়েছে সে।
দশ
সাত বছর পর।
মাজিদের বাবা-মা তাঁদের কথা রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের ছেলের বউকে তুলে নিলেন ঘরে। সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করা হলো ওই বিয়েতে।
মাজিদ এখন পড়ে মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে। ক’দিন পরেই হবে পুরোপুরি ডাক্তার। সুন্দরী জয়গুনও কম যায় না। সে-ও মেডিকেলে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। ওরা ঠিক করেছে, পাশ করার পর দু’জনেই গ্রামে ফিরবে। তারপর কাজেম আলীর দান করা বিশাল জায়গাটাতে গড়ে তুলবে হাসপাতাল। হাসপাতালের নামও ভেবে রেখেছে জয়গুন।
হাসপাতালের নাম হবে আশ্রাফ আলী মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
এগারো
সময়ের হাত ধরে কেটে গেল আরও দশটি বছর।
গ্রামে এখন আছে চমৎকার একটি হাসপাতাল। সেখানে শুধু এলাকার সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পায়, তা নয়। বরং এ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে দূর-দূরান্ত থেকেও আসে লোকজন। বেশিরভাগ মানুষ ভাল চিকিৎসার জন্য এলেও কেউ কেউ আসে পরীর মেয়ে জয়গুনকে দেখতে। অবশ্য ওকে কখনও ডাকা হয় না পরীর মেয়ে হিসেবে। সবাই তাকে বলে ডাক্তার জয়গুন।