ঘরের দাওয়ায় বসে বিস্তারিত শুনে হাশেম কবিরাজ ধ্যান করার মত চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। শেষে নড়েচড়ে লাঠিটা হাতে তুলে নেয়।
‘আশ্রাফ আলী…’
‘জী, হাশেম ভাই।’
‘তোমার জয়গুন সত্যিই পরীর মাইয়া।’
‘আর যারা আসছিল, ওরা?’
‘ওরা তার স্বজন।
তাইলে এখন কী করা, ভাই?’
‘রাক্ষসের সাথে বিয়া দিয়া ওরা তারে পরী রাজ্যে নিয়া যাইব এই কথাটা ঠিক না।’
‘কিন্তু ওরা তো এই কথাই কইল।’
‘শোনো, ওগো বোন মানুষের সন্তান পেটে নেয়াতে ওদের মনে প্রচণ্ড আক্রোশ চাপছে। এখন এই মেয়েটারে রাক্ষসের সাথে বিয়া দিয়া ওরা তার সর্বাংশে ক্ষতি করতে চাইতাছে। বুচ্ছো?’
‘কন কী, ভাই!’
‘হ।’
‘এর থাইকা মুক্তির উপায় কী? যেমনে হোক মাইয়াটারে বাঁচাইতে হইব। ওর কিছু হইলে আমরা বাঁচমু না।’
এবার কোনও উত্তর দিল না হাশেম কবিরাজ। সে বড় করে শ্বাস টেনে আবার চুপ হয়ে চলে গেল ধ্যানের গভীরে। বাড়ির সব সদস্য উদ্গ্রীব হয়ে কবিরাজের পাটির চারপাশে বসে আছে। একটু পরে হাশেম কবিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতে ধরে রাখা লাঠির গোড়াটা দিয়ে উঠানে আঁকল একটা বৃত্ত। ওটা আঁকা হয়েছে ওদের বসে থাকা জায়গাটা ঘিরে। আঁকা শেষে কবিরাজ আবার নিজের জায়গায় বসল।
‘আশ্রাফ আলী।’
‘জী।’
‘জয়গুনরে রাখতে হইলে শক্ত একটা কাজ করতে হইব। খুবই শক্ত কাজ।’
‘কী কাজ, হাশেম ভাই?’
‘পরীগো হিসাব মতে আগামী মাসের দুই তারিখে ওর বয়স তেরো হইব। ঠিক না?’
‘জী।’
‘তার আগে ওর একটা ক্ষতি কইরা দিতে হইব।’
‘এইডা কী কও, ভাই? ওর ক্ষতি!’
‘শোনো, একমাত্র ওর কোনও একটা ক্ষতি হইলেই জয়গুনরে তার খালারা আর নিতে চাইব না। কী করা যায় দ্রুত চিন্তা করো। সময় খুবই কম।’
আট
হাসনা ও জোছনার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তারা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়ে যার যার স্বামীর বাড়ি চলে গেছে। বিশেষ করে জয়গুনকে ধরে তাদের কান্না যেন থামছিলই না। আসলে কোলে-পিঠে মানুষ করা এই বোনটা ওদের কাছে খুব প্রিয়। জয়গুনকে ওরা কখনওই বাইরের মেয়ে, পরীর মেয়ে এভাবে দেখেনি।
আর সেই মেয়েটার কঠিন বিপদে ওরা কিছু করতে পারছে না, তা যে কী কষ্টের, কীভাবে সেটা বোঝাবে। তবুও বাস্তবতা সবচেয়ে বড় সত্য। একে মেনে নিতে হবে। অবশ্য হাশেম কবিরাজ চাচার কথা মত যদি কিছু করা যায়, তা হলে হয়তো মুক্তি মিলবে ওর।
কাজেম এ বাড়ির ছেলে। ও দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু বাড়িতে যে এমন জটিল অবস্থা হয়ে আছে, তা সে আন্দাজও করতে পারেনি।
এখন এমন এক বিপদে কোনও একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বয়স্ক বাবা-মা ও প্রাণপ্রিয় ছোট বোনকে ফেলে কোনওভাবেই চলে যাওয়া যায় না ভেবে থেকে গেল ও। আইন-সালিশ বা বিচার আচারের ব্যাপার হলে না হয় সে একাই লড়তে পারত। কিন্তু এটা এমন এক ব্যাপার, যাতে তার হাত-পা একেবারেই বাঁধা। এখানে কবিরাজ চাচা যেভাবে যা করে, তাতেই সম্মতি দিয়ে একটা সুরাহা করতে হবে।
কাজেম আলী বাড়ির দক্ষিণের আম বাগানের ভেতরে একা একা হাঁটছে। এই একটা বিষয়ই সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে ওর ভাবনায়। এমন সময় তার পেছনে খুট্ করে একটা শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল কাজেম। দেখে গুটিগুটি পায়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মাজিদ। ওদের বাড়ির ঘটনা এ পাড়া হয়ে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু কেউই কিছু করার উপায় জানে না। এ কারণে পুরোটা গ্রামই কেমন যেন থম মেরে গেছে।
‘কাজেম ভাই….’
‘কী, মাজিদ, কেমন আছ?’
‘ভাল আছি। আপনি?’
‘আছি একরকম।’
‘আপনাদের বিপদের কথা শুনছি। শোনার পর থাইকা আমার খুব খারাপ লাগতাছে।’
‘হ। জয়গুনের জন্য সবারই মন খারাপ রে।’
‘ভাই…’
‘হুম?’
‘একটা বুদ্ধি পাইছি। কমু?’
‘ক।’
‘পরীরা তো জয়গুনরে নিয়া বিয়াই দিব। ওরে, যদি আপনেরা বিয়া দিয়া দেন। তাইলে ওর একটা খুঁত হয় না?’
কথাটা কাজেমের পছন্দ হলো। হ্যাঁ, এমন একটা বিষয়ও হতে পারে। খুঁত বলতে, ওরা জয়গুনের হাত-পা কাটা-ভাঙা এসব ভাবছিল। হ্যাঁ, তা না করে অন্য কিছুও তো করা যেতে পারে।
কাজেম মাজিদকে কিছু না বলে বাড়ির দিকে দৌড়াল। এখনই খবরটা জানাতে হবে। মঙ্গলবার আসতে খুব বাকি নেই।
নয়
জয়গুনের জন্য এলাকা বা এলাকার বাইরে ভাল পাত্রের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুটো কারণে এ বিষয়ে কোনওরকম খোঁজখবর করা গেল না। এক: তারা ওর বিয়ের ব্যবস্থা করছে এটা পরীরা জেনে ফেললে সমস্যা হতে পারে। দুই: জয়গুনকে ওর মা খুব নরম করে তার কোনও পছন্দ আছে কি না জিজ্ঞেস করলে, সে কোনও বাছবিচার না করে মাজিদের নাম বলেছে।
কাউকে না জানিয়ে মাজিদসহ ওর বাবা, মা, কাজীসাহেব ও কবিরাজ এবং এ বাড়ির লোকজনের উপস্থিতিতে হয়ে গেল জয়গুনের বিয়ে। সোমবার বিকেলে ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন হলো এ বিয়ে। মাজিদ-জয়গুন নিজেরাও কখনও ভাবেনি এভাবে তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে। অথচ হয়ে গেল।
বিয়ে হলো, কিন্তু পরে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা করা হবে এ কথাও মাজিদের বাবা-মা আদায় করে নিল। তাদের আরেকটা দাবি ছিল, সেটা হলো মেয়ে সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়ের মেলামেশা চলবে না। এসব দাবি- দাওয়ার বিষয়ে কোনও অমত করেনি জয়গুন পরিবার
সন্ধ্যা গড়ালে কী না কী হয় ভেবে আশ্রাফ আলী হাশেম কবিরাজকে বাড়িতে রেখে দিয়েছে। সে-ও বেশ ভাল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আজকের জন্য। কবিরাজ জানে, ছেড়ে কথা বলবে না পরীরা। আজ তাদের তৈরি করা এই খুঁত দেখে যদি পরীরা খেপে যায়, তা হলে যে কী করে, সেটা বলা যায় না।