‘এত রাইতে কে না কে! দরজা খুলবা?’
‘এই সময়ে কে আসতে পারে? বুঝতেও পারতাছি না।’
‘দরজা না খুললে কেমন হয়?’
‘না-না, দেখি।’ তারপর আশ্রাফ গলা উঁচু করে বলে, ‘কে? কে দরজার বাইরে?’
‘আমরা। হামিদা আর সুখরান।’
নামগুলো একেবারেই অপরিচিত। কারা এরা? তবে মহিলা কণ্ঠ স্পষ্ট এবং জোরালো। আশ্রাফ ছিটকিনি খুলে দরজার পাল্লা মেলে ধরে।
ভেতরে ঢোকে দু’জন ঝলমলে পোশাক পরা নারী। উচ্চতায় আশ্রাফ আলীকে ছাড়িয়ে গেছে দু’জনেই। চেহারা খুবই সুন্দর। মনে হচ্ছে মুখমণ্ডল থেকে বুঝি বেরিয়ে আসছে আলোর ঝিলিক।
‘আপনারা? এত রাইতে?’
‘আমরা পরী। জয়গুন আমার বড় বোনের মেয়ে।’
‘কী!’
‘জী, সত্যি বলতেছি আমরা।’
‘এখন কেন আসছেন?’
‘আর ছাব্বিশ দিন পর ওর বয়স তেরো হইবো। তার আগেই ওরে আমরা নিয়া যামু।’
‘জয়গুনরে নিয়া যাইবেন! ফাইজলামি পাইছেন! জয়গুন আমার মাইয়া। ওরে আমি কোথাও যাইতে দিমু না।’
হামিদা নামের পরী হাসে। অসম্ভব সুন্দর হাসি। হাসির সঙ্গে তার দাঁতগুলো হারিকেনের হালকা আলোতেও ঝিক্ ঝিক্ করছে।
‘বড় হাসির কথা বললা, আশ্রাফ আলী। তোমার এক ছেলে দুই মেয়ে। ও পরীর মেয়ে জয়গুন। সে তোমাদের মেয়ে হবে কেন?’ হামিদা বলে।
‘শোনো,’ কথা বলে সুখরান, ‘আমার বোন মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করায় ওর জন্ম হয়। জন্মের সময় আমার সেই বোন মারা যায়। মানুষের রক্ত ওর শরীরে থাকায় ওরে আমরা পরীস্থানে নিতে পারি নাই।’
‘আর তাই তারে তোমার ঘরে জায়গা করার ব্যবস্থা করি,’ কথা বলে হামিদা। ‘এখন জয়গুনের তেরো বছর পূরণ হওয়ার সাথে সাথে ওরে নিয়া আমরা এক রাক্ষসের সাথে বিয়া দিব। তারপর সে পরীস্থানে ঢুকতে পারব।’
‘সব বুঝলাম। তোমাদের এই গাল-গল্পের কোনও প্রমাণ নাই। অতএব তোমরা ওরে কোনওভাবেই পাইবা না,’ আশ্রাফ আলী যুক্তি দেখায়।
‘শোনো, আমরা আবার আসব। এখন কথাটা জানাইয়া গেলাম।’
কথাটা বলেই ওরা যেভাবে এসেছিল সেভাবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু হেঁটে উঠানের মাঝ বরাবর গিয়েই হামিদা ও সুখরান হঠাৎ উড়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ করার বদলে আশ্রাফ ও ময়না অদ্ভুত দৃশ্যটা হাঁ করে দেখল। দু’জনের পিঠে কি ডানা লুকানো ছিল? এতক্ষণ তো তা দেখেনি ওরা! কিন্তু সত্যি সত্যি হামিদা ও সুখরান নামের দুই পরী অনেক অনেক উঁচুতে উড়ে গেছে।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় গেল আশ্রাফ আলী। কী ঘটল এটা ভেবে শরীরে ঘাম এসে গেছে। ময়নার এগিয়ে দেয়া পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোকে সবটা পানি খেয়ে নিল সে। আরও পিপাসা লাগছে তার। এ মুহূর্তে বোধহয় এক পুকুর পানিও খেয়ে ফেলতে পারবে আশ্রাফ আলী।
ছয়
সর্ষের তেল দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত মেখে খাওয়াটা আশ্রাফ আলীর খুব পছন্দ। সেই ছোটবেলা থেকেই এভাবে খেতে ভাল লাগে তার। কোনও তরকারি না থাকলে এরকম তেল দিয়ে দুই প্লেট ভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে যেত সে। অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে। জয়গুন এসে তার পাশে বসে খেতে শুরু করল। সামনে সব সাজিয়ে দিয়ে ময়নাও খেতে বসে গেল। খুব তাড়া না থাকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আশ্রাফ আলীকে চোখের ইশারায় রাতের ঘটনাটা এখুনি জয়গুনকে বলতে মানা করে ময়না।
খাওয়ার পর্ব শেষ হয়। তারপর বড় জামবাটিতে দই বেড়ে দেয় ময়না। আগে ভাত দিয়ে দই মাখিয়ে খেলেও এখন খালি দই খায় আশ্রাফ আলী। জয়গুন ওর বাটির দইয়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে নেয় খানিকটা।
‘জয়গুন।’
‘জী, বাবা।’
‘তোর পড়ালেখা কেমন চলতাছে?’
‘ভালই, বাবা।’
‘কোনও সমস্যা নাই তো!’
জয়গুন ওর প্রেমপত্রের বিষয়টা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায়, এ ঘটনা এখন পর্যন্ত মাজিদ ও তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ওর বাবা পর্যন্ত যায়নি। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।
‘না, কোনও সমস্যা নাই।’
দইয়ের খালি বাটি নামিয়ে রাখে আশ্রাফ আলী। পানি খায় এক গ্লাস। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে লুঙ্গিতে হাতটা ঘষে। ‘মা, একটা কথা বলি তোরে।’
গতরাতের ঘটনাটা মোটামুটি আদ্যোপান্ত বলে আশ্রাফ আলী। ময়না মেয়ের চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করে তার প্রতিক্রিয়া।
সবটুকু বলা শেষ করা মাত্র জয়গুন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। কান্না একটু থামলে কথা বলে ও। ‘বাবা-মা, তোমরা ওইসব বিশ্বাস কইরো না। ওরা আমার কেউ না। বিশ্বাস করো। আমি তোমাগো মাইয়া। তোমরা দরকার হয় আমারে মাইরা-কাইট্যা পানিতে ভাসাইয়া দেও। আমি তোমাগোরে ছাইড়া কোথাও যামু না। কোথাও না।’
কাঁদতে কাঁদতে জয়গুন একেবারে আশ্রাফ আলী ও ময়নার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে। তারা মেয়েকে নানান কথা বলে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে যায়।
বিষয়টা অতি জরুরি। এ কারণে আশ্রাফ আলী তার সব ছেলেমেয়েকে দ্রুত বাড়িতে ডাকে। জয়গুন কোনও ঝামেলা করেছে ভেবে দেরি না করে ওরা সবাই ছুটে আসে।
পরদিন ছেলেমেয়েদের একই গল্প বলে আশ্রাফ আলী। হতবিহ্বল কাজেম, হাসনা ও জোছনা কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারল না। হঠাৎ কথা প্রসঙ্গে হাশেম কবিরাজের নামটা আসে। পরে ঠিক হয় দুপুরের পরপরই তাকে ডেকে আনা হবে। হয়তো এই বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে সে।
সাত
হাশেম কবিরাজ। বয়স সত্তরের ওপরে। তবে বয়সের তুলনায় তার কাঠামো বেশ শক্তপোক্ত। মাথার চুল হয়ে গেছে সব সাদা। লম্বা চুলগুলো ছুঁই-ছুঁই করছে কোমর। মাঝারি উচ্চতার লোকটার হাতে সবসময় থাকে একটা লাঠি। ওটার ওপরে মানুষের মুখ আঁকা।