গ্রামের অন্য মাথায় হাই স্কুল। সেই স্কুলে মেধাবী মেয়ে জয়গুন পড়বে তা দিনের মত পরিষ্কার। খুব খুশি হয়েই হাই স্কুলের হেডমাস্টার রহিম মিয়া তাকে ভর্তি করে নিলেন। জয়গুন এখন হাই স্কুলে পড়ে। কী আনন্দ তার মনে!
জয়গুন স্বপ্ন দেখে সে অনেক বড় হবে। সমাজের সবচেয়ে মহৎ পেশা হবে তার পেশা। হ্যাঁ, সে ডাক্তার হবে। এটাই মনে মনে ঠিক করে ফেলে ও। তাকে লোকজন পরীর মেয়ে বলে, এটা সে-ও শুনেছে। তবে জয়গুন মনেপ্রাণে আশ্রাফ আলী ও ময়নাকেই তার বাপ-মা বলে জানে। লোকে যা বলে বলুক। হয়তো সে খুব সুন্দরী বলেই তারা এমনটা বলে।
বিলে বাতাস বয়ে যায় প্রতিদিন। গাছের পাতা মর্মর শব্দে হাওয়া দেয়। কাছের ‘মেঘনা নদীতে কুল কুল বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরে জেলেরা।
জয়গুন বাড়িতে আসার পর আশ্রাফ আলীর সংসারের চেহারা বদলে যায় দ্রুত। সব কিছুতেই তার উন্নতি আর উন্নতি হতে থাকে। এমনকী তার বাড়িতে অর্থও আসতে শুরু করে। সে যা করে, তাতেই টাকা আসে ঘরে। ময়নার বহু দিনের শখ ছিল সাতনরী হার গড়ানোর। অনেকগুলো টাকা জমিয়ে রতনপুর বাজার থেকে আশ্রাফ আলী গোপনে স্ত্রীর জন্য সাতনরী হার গড়িয়ে আনে।
সাতনরী হার গলায় পরে হাসে ময়না। ভুবন ভোলানো হাসি হয়তো একেই বলে। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে এমন তৃপ্তির জীবন, সুখের জীবন কয়জন নারীর ভাগ্যে জোটে!
বিয়ে হয়ে গেছে হাসনা ও জোছনার। অবস্থাসম্পন্ন আশ্রাফ আলীর বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং মেয়েরা সুন্দরী ও শিক্ষিত হওয়ায় বড় ঘরেই দিতে পেরেছে ওদেরকে। তা ছাড়া, বিভিন্ন উপলক্ষে জামাইবাড়ির সবার জন্য উপহার- উপঢৌকন পাঠিয়েও সকলের মন জয় করে রেখেছে আশ্রাফ আলী। আত্মীয়-স্বজনরা সামনা-সামনি তার প্রশংসা করলেও আড়ালে এই উন্নতির জন্য হিংসা না করে পারে না।
হাসনার এক ছেলে ও এক মেয়ে, আর জোছনার দুটোই ছেলে। এদিকে বছর তিনেক আগে ডিগ্রি পাশ করে ঢাকায় চাকরিতে ঢুকেছে আশ্রাফ আলীর ছেলে কাজেম। তার জন্যও খোঁজা হচ্ছে পাত্রী। তবে কাজেমের পছন্দ মত মেয়ে না পেলে জোর চেষ্টা করবেন না আশ্রাফ আলী। কারণ ঢাকায় পড়ালেখা করা ছেলের ঢাকাতেই কাউকে পছন্দ থাকতে পারে, বা কথা দিয়ে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্রামের কোনও মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। হিসাবী আশ্রাফ আলী সংসারের বিষয়ে খুবই সচেতন।
স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় জয়গুন। সে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে কেঁপে উঠছে বারবার। তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র মাজিদ গত কয়েকদিন ধরে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ওর পিছু নিত। ছাত্র হিসেবে ভাল মাজিদ। রোল নম্বরও প্রথম দিকেই ওর। তবুও পিছনে পিছনে ঘুর-ঘুর করাটা বেখাপ্পা ঠেকছে জয়গুনের।
ঘোরাঘুরির কয়েকদিন কেটে গেলে জয়গুনের বান্ধবী বীথি বলেছিল, ‘মাজিদ মিয়া তোর প্রেমে পড়ছে, জয়গুন। তোর প্রেমে পড়ছে।’
সেদিন এ কথাটা শুনে পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর। জয়গুন ভেবেছে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে ও। এসব প্রেম-ভালবাসায় মন গেলে পড়ার ক্ষতি হবে। কোনওভাবেই ওসবে যাবে না ও। জড়াবে না, জড়াবেই না।
মাজিদ যদিও তার পিছু ছাড়েনি, কিন্তু জয়গুন কোনওরকম সাড়া দেয়নি বা অন্য দুষ্টু মেয়েদের মত করে মাজিদকে পেছনে পেছনে ঘোরানোর জন্য দেখানো হাসি হাসেনি। এসব মিথ্যে ছল করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। সে সবসময়ই নিজের কাছে সৎ থাকবে, এমনটাই ছিল ওর নীতি।
বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে জয়গুন স্কুল ব্যাগের পকেট থেকে বের করল চিঠিটা। ছোট ভাঁজ করা কাগজ। ভেতরের বর্ণগুলো নীল
বর্ণগুলো নীল কালিতে সাজিয়ে লিখেছে পত্রলেখক। এটাই প্রেমপত্র। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেমপত্র প্রত্যেক মেয়ের কাছে ভীষণ আগ্রহের, আকর্ষণের। কিন্তু জয়গুন কোনওভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না।
রাগ হচ্ছে তার। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব। মাজিদ প্রেমপত্র পাঠাতে আর কাউকে পেল না। বেছে বেছে তাকেই দিতে হবে এই বিশ্রী চিঠি। বাবা-মা জানলে কী ভাববে ওকে! তা ছাড়া, বড় ভাইয়া, আপুরা আছে। তারা শুনলে কি কখনও বিশ্বাস করবে, ওর কোনও ভূমিকা নেই এই প্রেমপত্রে!
কী করবে জয়গুন! বাবাকে ডেকে দেখাবে চিঠিটা? মাকে পড়ে শোনাবে লেখাটা? কিছুটা সময় ভেবে চলে ও। না, কাউকে কিছু জানাবে না। কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে না। সে একাই চেষ্টা করবে মাজিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটাকে এখানেই থামিয়ে দেয়ার।
চিঠিটা খুলে দেখে একবার। ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে হাতে লেখা চিঠি। হাতের লেখাও খুব সুন্দর। চোখ টেনে নেয়। পড়বে না পড়বে না করেও পড়ে জয়গুন। পড়ার পর কেমন এক মিশ্র অনুভূতি ওর ভেতরে খেলা করে যায়। ওকে ভালবাসে একজন। ভালবেসে চিঠি দিয়েছে। এটা জনে জনে না বলে মাজিদকেই সরাসরি জানিয়ে দেবে, তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দরজার বাইরে শব্দ হয়। ময়না দরজা ধাক্কা দেয়।
‘জয়গুন, দরজা বন্ধ করলি ক্যান? ভাত খাবি না!’
‘আসি, মা। কাপড় বদলাইয়া আসতাছি।’
জয়গুন আরও অনেকটা সময় পর বের হলেও ভিন্ন অনুভূতিটা তার মন-প্রাণ ছুঁয়ে থাকে। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে।
পাঁচ
রাতে ঘুমাচ্ছে পুরো গ্রাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আশ্রাফ আলী ও ময়না শুয়ে পড়েছে। পড়াশোনার খুব চাপ বলে জয়গুন দেরি করে ঘুমাতে যায়। ও ঘুমিয়েছে, তা-ও ঘণ্টাখানেক হয়। এমন সময় দরজায় শব্দ হলো। একাধিকবার জোরে জোরে শব্দ হলে ঘুম ভেঙে গেল আশ্রাফের। সে চোখ মেলে ময়নাকেও ডেকে তোলে। তারপর দরজা খুলতে উদ্যত হয় আশ্রাফ।