আশ্রাফ আলী ভাবতে লাগল, এটা এখানে এল কী করে?
সে চলে গেলে এর কী হবে?
ধারেকাছে কোনও বাড়ি নেই। তার মানে, সে চলে গেলে মরে যাবে বাচ্চাটা!
বুকটা কেঁপে উঠল তিন সন্তানের বাপ আশ্রাফ আলীর। মন বলল, বাচ্চাটাকে নিয়ে যা। বাড়িতে নিয়ে যা!
দুই
বাড়িতে মাছ আনলে চেঁচামেচি করবে ভেবেছিল ময়না, কিন্তু আশ্রাফ আলীর কোলে ছোট্ট পুটলিতে বাচ্চাটাকে দেখে বেমালুম ভুলে গেল চিৎকারের কথা। এক দফা চিৎকার শুরু করার আগেই আশ্রাফ আলী ছোট্ট পুটলিটা ধরিয়ে দিতে চাইল তার হাতে।
‘ময়না, কোনও কান্নাকাটি করিস না। আমি এই বাচ্চাটারে বিলে পাইছি। কচুরিপানার মইধ্যে। খোদার কসম, এতে অন্য কোনও কিছু নাই। ওর কী লাগব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর। বাচ্চাটারে বাঁচাইতে হইব।’
একটানা কথাগুলো বলে থামে আশ্রাফ আলী। তার কথার ফাঁকে বাড়ির বাচ্চা তিনটাও এসে বাবা-মাকে ঘিরে দেখছে ছোট শিশুটাকে। ময়নার জেগে উঠেছে মাতৃত্ব, সে নিজের কোলে নেয় শিশুটিকে। এতে মহাখুশি হয় আশ্রাফ আলী। যাক, বিতং করে দেরি করিয়ে দেয়নি ময়না। বাকি ঘটনা পরেও বলা যাবে। এখন দরকার এই শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা। ময়নার ছোট্ট বাচ্চা জোছনার বয়স আট বছর। তাই ময়নার বুকে এখন কোনও দুধ নেই। তা হলে, এইটুকুন শিশু খাবে কী!
ধ্যাৎ! এখন এসব ভাবনা নয়। আশ্রাফ আলী বাইরের কাজ সেরে আসা পর্যন্তই জানে। ঘরে যে কীভাবে কী হয় সে বিষয়ে তাকে কখনও মাথা ঘামাতে হয়নি। ময়না তার জাদুকরী হাতে সব করে ফেলে। এমনও দেখা গেছে টানা বৃষ্টিতে বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। বাজার করাও বন্ধ। অথচ ময়না খিচুড়ি, ঘি, বাচ্চা মুরগির মাংসের সঙ্গে চার-পাঁচ পদের ভর্তা রেডি করে খেতে ডাকে।
একবার ঘরে কী আছে বা নেই জানা ছিল না আশ্রাফ আলীর। হঠাৎ তিন-চারজনকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে সে আওয়াজ দেয় যে, তারা খাবে। টু শব্দটিও না করে ময়না কেবল বড় মোরগটা জবাই করে দিতে বলে। ব্যস, এটুকু করেছিল সে।
কিন্তু খাবার খেতে বসে আশ্রাফ আলী তো বটেই, অতিথি চারজনও অবাক হয়েছিল। পোলাও, গরুর গোশ্ত, মুরগির মাংস, বড় মাছ, ডিম ভুনা, দুধের সঙ্গে কলা এবং আশ্চর্যের বিষয় সব শেষে পাতে মিষ্টিও তুলে দিয়েছিল ময়না। যদিও সবগুলোই আশ্চর্যজনক। একজন অতিথি তো বলেই বসেন, ‘মিয়া, সব আয়োজন কইরাই আমগোরে আনতে গেছ তুমি, তাই না!’
এ কথা শুনে আশ্রাফ আলীর মুখে কোনও কথা জোগায়নি। সত্যিই সে কিছু করেনি। সব করেছে ময়না। কোনও কথা না বলে চুপ করেই থাকে সে। এ রকম ঘটনা অনেক আছে। ময়না আসলেই তার সংসারের লক্ষ্মী। কখনও তার কথায় অমত করেনি। সেই ময়না এখন বিলের শিশুটাকে কোলে তুলে নিল মানে ওর আর ভাবনা নেই। আল্লাহর রহমতে শিশুটা এখন বেঁচে গেলেই হয়।
তিন
ময়না শিশুটাকে কেবল কোলেই তুলে নেয় না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে: আমি ওকে নিজের সন্তানের মত আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করে তুলব। কোনও কিছুর কমতি হতে দেব না এর।
ময়নার মত তার তিন সন্তানও সহজভাবেই নেয় নতুন শিশুটিকে। বিশেষ করে হাসনা ও জোছনা তো মেয়ে শিশুটির জন্য পাগল হয়ে ওঠে। তাকে কোলে নিতে হবে, নিজের পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে, আরও কত কী!
প্রথমে নবাগত এই শিশুটিকে বিলের কন্যা, বিলের কন্যা বলে ডাকা হতে থাকে। প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও কেউ এর দাবি নিয়ে আসা দূরের কথা, অমুক বা তমুকের সন্তান হতে পারে, তেমনটাও জানা যায় না। শেষে এই শিশুর নাম বিলের কন্যা পাল্টে হয়ে যায় পরীর মেয়ে।
হ্যাঁ, এমন দুধ-আলতা গায়ের রঙ, টানা টানা চোখ, মিশমিশে কালো চুল, একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না-এটা পরীর মেয়ে না হয়ে যায়ই না!
আশপাশের গ্রাম থেকে কম মানুষ ওকে দেখতে আসেনি। অথচ কেউ একটাবার এর পরিচয় জানে, বলতে পারেনি। সুতরাং পরীদের মেয়েই এটা। ওরাই বিলে ফেলে গেছে। বিশেষ করে আশ্রাফ আলীর মত একজন দিলদরিয়া মানুষকে লক্ষ্য করেই এ কাজটা করেছে তারা। কারণ পরীরা জানত এই লোকটা বাচ্চাটাকে ফেলে আসতে পারবে না।
এভাবেই পুরো গ্রাম এমনকী ইউনিয়নের ছোট-বড় সকলে জেনে গেল আশ্রাফ-ময়নার ঘরে একটা পরীর মেয়ে আছে। নিজেদের ছোট বোনকে বারবার পরীর মেয়ে, পরীর মেয়ে শুনতে হাসনা ও জোছনার খুব একটা ভাল্লাগে না। ওরা দু’দিন খুঁজে খুঁজে এই শিশুর একটা নাম বের করে ফেলে। ওর নাম রাখা হয় জয়গুন। পরীর মেয়ে জয়গুন।
চার
বাড়ির সবার আদর ভালবাসা আর গ্রামের মানুষের স্নেহে দিন দিন বড় হতে থাকে জয়গুন। নামের মতই গুণবতী হয়েছে মেয়েটা। আর দেখাশোনায় তো অপূর্ব, অতুলনীয়। এমন রূপবতী মেয়ে সারা দেশে আরও একটা আছে কি না সন্দেহ। আসলেই সে পরীর মেয়ে। আড়ালে আবডালে সকলে এটা বিড়বিড় করে বলতে বাধ্য হয়।
অন্য বাচ্চাদের মত জয়গুনও পড়াশোনা করবে। সে বাড়ির কাছের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। তার বড় তিন ভাই-বোন এ স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। সে-ও ‘পড়বে। প্রথম দিন থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠে জয়গুন।
স্কুলের শিক্ষকরা বলাবলি করে, মেয়েটা অসম্ভব মেধাবীও বটে। সে ঠিক মত পড়াশোনা চালিয়ে গেলে তার অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে অনেক ভাল ফলাফল করবে নিশ্চিত। শিক্ষকদের অভিজ্ঞ মন্তব্য ভুল হয় না। সত্যি সত্যি জয়গুন কৃতিত্বের সঙ্গে পুরো ইউনিয়নে ভাল ফলাফল করে প্রাইমারি পাশ করে।