পরী – হাফিজ রাসা
এক
সবে ভাদ্র মাস। যতদূর চোখ যায় চারদিকে থৈ-থৈ পানি। আরও অনেক পরে শুকোবে বর্ষার ঢল। এ সময় কাজ থাকে না গ্রামের কৃষকদের। খেয়ে, ঘুমিয়ে আর গল্প-গুজব করে বেশিরভাগ মানুষ কাটায় তাদের সময়।
আবার হাতের কাজ করে কেউ। জাল বোনে, পলো বানায় কিংবা বাড়ির মহিলাদের ফরমায়েশ মত সারায় গৃহস্থালির জিনিসপত্র। কাউকে কাউকে দেখা যায় জাল, ছিপ কিংবা আনতা (মাছ ধরার খাঁচা) নিয়ে মাছ শিকারে মেতে উঠতে। আশ্রাফ আলী এই শ্রেণীর লোক।
বাড়িতে বসে থাকা ধাতে সয় না তার। দিনে ঘুমানোর তো প্রশ্নই আসে না। তার মতে, আল্লাহ রাত দিয়েছেন ঘুমাতে আর দিন হলো কাজ করার জন্য। সুতরাং দিনে ঘুমিয়ে কেন কাজের সময়টাকে নষ্ট করা!
অবস্থাসম্পন্ন না হলেও পরিশ্রমী আশ্রাফ আলীর পরিবার সুখেই আছে। স্ত্রী ময়না, এক ছেলে কাজেম আলী ও দুই মেয়ে হাসনা ও জোছনাকে নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছে তার দিন। নিজের জমিতে কাজ শেষ হলে, তারপর বাড়তি সময়ে পরিশ্রম করে অন্যের জমিতে।
তার আছে হালের একজোড়া পুরুষ্টু বলদ এবং দুটো গাভী। সবসময় দুধ দেয় একটা গাভী। বাড়ির দুধের চাহিদা মেটার পরেও বিক্রি করতে পারে খানিকটা দুধ। সেই টাকায় কিনতে পারে প্রতিদিনকার দরকারি সদাই।
আড়াল-আবডালে নানান কথা বললে বা হিংসা করলেও মুখোমুখি কিছু বলার সাহস পায় না গ্রামের কেউ। কারণ আশ্রাফ আলী অত্যন্ত সৎ মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। তার মতে, অন্যের পিছে দৌড়ালে আমার পেট চলবে, কিন্তু পরিবারের পেট চালাতে হলে চাই কাজ করা।
যুক্তি আছে তার কথায়।
যারা মেম্বার-চেয়ারম্যান বা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কল্কি ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কারও আর্থিক অবস্থা আশ্রাফ আলীর মত নয়। সে বিশ্বাস করে আল্লার ইবাদতের পর সংসার ধর্মই বড় ধর্ম।
আজ দুপুরে খেতে গিয়ে দেরি হয়েছে তার। আগেই বিলে মাছ ধরতে যাবে ভেবেছিল আশ্রাফ আলী। তাই দেরি হয়ে গেলেও ডিঙি নৌকায় বড়শি ও আনতা তুলে রওনা দিল। এ বেলা জমির আলের পাশে পানির স্রোতে বসাবে সব। আগামীকাল ফজর নামাযের পর গিয়ে তুলে নেবে।
মাঝের এ সময়ে মাছ ধরার গ্রাম্য এসব যন্ত্রে আটকা পড়ে প্রচুর মাছ।
সকালে বাড়িতে যখন ঢেলে দেয়া হবে, এত মাছ দেখে বিরক্ত হবে ময়না। এতই বেশি, একা কেটে শেষ করতে পারে না সে। তখন দা-বটি এনে মাছ কেটে সাহায্য করে আশপাশের বাড়ি থেকে ফজুর বউ, জমিলার মা কিংবা জজির মা। কাটাকুটি শেষে ফেরত যাওয়ার সময় ওদেরকে প্রচুর মাছ দিয়ে দেয় ময়না।
জায়গা দেখে দেখে তার আনতা ও চাঁইগুলো বসায় আশ্রাফ আলী। কোথাও বুক সমান পানি, কোথাও আরও বেশি। কিন্তু জায়গা পছন্দ হওয়া মাত্র নৌকা থেকে টুপ্ করে নেমে যায় সে। কতবার নামল আর কতবার উঠল এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না সে।
কাপড় ভিজে একসা। সব কাজ শেষ হলে এবার সকালবেলা তুলে নেয়া হয়নি এমন দুটো আনতা নৌকায় তুলে নিল আশ্রাফ আলী। প্রত্যেকটাতেই খল্-বল্ করছে মাছ। এগুলো বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ময়না খুব খেপবে আজ। স্ত্রীর রেগে ওঠা চেহারাটা মনে করে আপন মনে হেসে, ফেলল সে।
কী কম বয়সেই না ময়নাকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে এনেছিল? অবশ্য নিজে যে ময়নাকে বিয়ে করে এনেছিল, তেমনটা নয়। আশ্রাফ আলীর বাপ ময়নার বাপকে অনেক আগেই কথা দিয়ে রেখেছিল। নিজেদের ছেলে ও মেয়ের বিয়ে দেবে তারা।
হঠাৎ একদিন সাপের কামড় খেয়ে ময়নার বাপ মারা গেলে আশ্রাফ আলীর বাপ দেরি করেনি। আবার কখন কার কী হয়, বলা যায় না। পরে কথা রাখা না গেলে মৃত মানুষটার কাছে লজ্জিত হতে হবে তাকে।
আশ্রাফ আলী ভেজা কাপড়ে উঠে বসল নৌকায়। আজকের মত তার কাজ শেষ। এখন শুধু নৌকা বেয়ে বাড়ি পৌছানো। আনতা দুটোর মাছ নৌকায় তুলে আনার পর থেমে থেমে লাফাচ্ছে মাছগুলো। দুই আনতায় সব মিলিয়ে পাঁচ-ছয় কেজি মাছ হবে। নৌকা বাইতে বাইতে আশ্রাফ আলী ভাবল, আজকে ময়না এই মাছ কুটতে রাজি না হলে শুঁটকি দিয়ে ফেলতে হবে।
বিলটা পার হয়ে খালে পড়লে বাড়ি পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। বর্ষার পানিতে ধানি জমি সব ডুবে বিলটাকে দেখাচ্ছে নদীর মত। বিলের চক্-চক্ করা শরীরে নামছে সন্ধ্যা। হাতের লগিটা ঠেলে বিল শেষে ধানখেতে ঢুকবে আশ্রাফ আলী, এসময় শুনল ‘ওয়া’-’ওয়া’ শব্দ। ধারেকাছে কোথাও বুঝি কাঁদছে কেউ।
থমকে গিয়ে চারপাশে তাকাল আশ্রাফ আলী। প্রথমে ভাবল, ভুল শুনেছে।
কারণ বিশাল এই পানিময় জমিনে বাচ্চার কান্না আসবে কোথা থেকে!
তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে এ সময়টাকে বলে তিন সন্ধ্যা। এ সময়টাতে মাছ নিয়ে যাচ্ছে বলে কি ‘ওঁরা’ তার সঙ্গে কিছু করছে?
আশ্রাফ আলী তিনবার কুলহু আল্লাহ সূরা পড়ে বুকে ফুঁ দিল।
কিন্তু না, আরেকবার শুনতে পেল সে কান্নার শব্দ। তার ভুল হতে পারে না।
এবার লগি দিয়ে ধানখেতে কিছু দেখা যায় কি না চেষ্টা করল।
একটু পর সন্ধ্যা নেমে গেলে কিছুই দেখা যাবে না আর। হঠাৎ দেখল বেশ ক’টা কচুরিপানার ওপর পুটলির মত জিনিসটা।
নৌকাটাকে ওটার কাছে নিল আশ্রাফ আলী।
হ্যাঁ, ন্যাকড়ার ভেতর হাত-পা ছুঁড়ে ওয়া-ওয়া করছে ছোট বাচ্চাটা, আবার থেমে যাচ্ছে।