ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘দেখছেনই তো আমাদের মাথার উপর কোনও গার্ডিয়ান নেই। এমনিতেই মেয়ে বড় হলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। তার ওপর মেয়ে যদি সুন্দরী হয় তা হলে তো কথাই নেই। সুন্দরী মেয়েদের বাবা-মায়েরা মেয়েকে সুপাত্রের হাতে তুলে দেবার আগ পর্যন্ত এক ধরনের অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটায়। এ ছাড়া ঈশিতা আজকালকার অন্যান্য মেয়েদের মত ততটা চালুও নয়। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বেরোয় না। তা-ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে। আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন ওকে কে দেখবে? তাই আমি থাকতে-থাকতে ওর একটা ব্যবস্থা করে রেখে যেতে চাই।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘আপনার কি বড় ধরনের কোনও অসুখ রয়েছে?’
ইয়াসমিন বেগম সংকুচিত গলায় বললেন, ‘না, তেমন বড় কোনও অসুখ নেই। তবে মাথা যন্ত্রণা আছে। ভয়ানক মাথা যন্ত্রণা। যখন মাথা ব্যথাটা শুরু হয় দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। নিজের মেয়েকে পর্যন্ত চিনতে পারি না।’
‘ডাক্তার দেখাননি?’
‘দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে মাইগ্রেনের ব্যথা। ওষুধ লিখে দিয়েছে। আর বলেছে, মাইগ্রেনের ব্যথা কখনওই পুরোপুরি সারে না। মাঝে-মাঝে ব্যথা উঠবেই। তবে আগে খুব কম উঠত। বছরে একবার কি দু’বার। আজকাল ঘন- ঘন উঠছে।’
সুলতানা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলেকে দেখে আপনার কি পছন্দ হয়েছে?’
ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘চোখের দেখা দেখেই কাউকে কি পছন্দ বা অপছন্দ করা যায়? আপনার ছেলে দেখতে সুন্দর। তাই বলে মানুষ হিসেবে সে কতটা পছন্দসই তা তো আর এক দেখায়ই বোঝা যাবে না। যেমন ঈশিতার বাবার কথাই ধরুন, লম্বা-চওড়া সুপুরুষ ছিল। কিন্তু ভিতরে ভয়ঙ্কর এক কুৎসিত মনের মানুষ!’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘তা ঠিক, মানুষকে উপর থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই। তবে আপনি যেমন বললেন না, আজকালকার অন্যান্য মেয়েদের মত আপনার মেয়ে নয়। তেমনই শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমার ছেলেও আজকালকার অন্যান্য ছেলেদের মত নয়। এমন একটা ছেলে আপনি লাখে খুঁজে পাবেন না।’
ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘এটা ঠিক, আপনার ছেলেকে দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। আমি লক্ষ করেছি এতক্ষণে সে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। এমনকী ঈশিতার দিকেও নয়। তেমন ছেলে হলে এতক্ষণে কয়েকবার ঈশিতার দিকে তাকানোর কথা ছিল।’
সুলতানা বেগম হেসে বললেন, ‘আপনার মেয়েও কিন্তু একবারও চোখ তুলে তাকায়নি।’
শাহজাহান ঘটক চায়ের কাপে বিস্কিট ভিজিয়ে খেতে- খেতে বলে উঠল, ‘খাপে খাপে মিইল্যা গেছে। যেমন ছেলে তেমনই মেয়ে। আর দেরি কীসের!’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘সত্যিই আপনার মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’ হেসে ফেলে আরও বললেন, ‘আপনাকেও পছন্দ হয়েছে। এখন আপনার কী মত?’
ইয়াসমিন বেগমও হেসে ফেললেন। হাসি মুখে বললেন, ‘আপনাকেও আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
শাহজাহান ঘটকের যেন আর তর সইল না। সুড়ৎ-সুড়ৎ করে কয়েক চুমুকে কাপের চা শেষ করে, চায়ে ভিজিয়ে খাওয়া বিস্কিটের যে নরম টুকরো কাপের তলায় জমেছে তা আঙুল দিয়ে ঘুঁটে খেতে-খেতে বলল, ‘তাইলে এহনই পাকা কথা হইয়া যাউক।’
সুলতানা বেগম তাঁর হাত থেকে একটা সুন্দর আংটি খুলে ঈশিতার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দেখি, মা, তোমার হাতটা দেখি।’
ঈশিতা এক মুহূর্তের জন্য তার মায়ের দিকে তাকিয়ে সুলতানা বেগমের সামনে হাত মেলে ধরল। সুলতানা বেগম ঈশিতার অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিলেন।
শাহজাহান ঘটক মোনাজাত ধরার ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ!’
সুলতানা বেগম হাসি মুখে শাহজাহান ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ কীসের জন্য? এনগেজমেন্ট হয়ে গেল এই জন্যে, না সব খাবার খেয়ে শেষ করতে পেরেছেন বলে?’
সুলতানা বেগমের কথা শুনে ইয়াসমিন বেগমও হেসে উঠলেন। শাহজাহান ঘটক দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে বলল, ‘এনগেজমেন্ট যহন হইছে, নিশ্চয়ই খাওন-দাওনের আরও ব্যবস্থা হইবে। তহন আবার শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।’
সুলতানা বেগম এবং ইয়াসমিন বেগম দু’জনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
শাহজাহান ঘটক বলে উঠল, ‘ছেলে-মেয়েগো নিজেদের মইধ্যে একটু কথা বলার ব্যবস্থা কইরা দেওন উচিত। তাগো নিজেগোও তো একে-অপরের কাছে কিছু জাননের থাকতে পারে।’
সুলতানা বেগম এবং ইয়াসমিন বেগম দু’জনেই গলা মিলিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছেন, শাহজাহান ভাই।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘যান, ভাই, আপনিই ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বাইরের বারান্দায় কথা বলার জন্য রেখে আসেন।’
ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘শাহজাহান ভাই, চিন্তার কিছু নাই, আপনার জন্য আবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি আগেই কাচ্চি বিরিয়ানী করে রেখেছিলাম। গরম করেই নিয়ে আসছি।’
শাহজাহান ঘটক জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ‘আফা, বিরিয়ানীর লগে আচার হইলে আরও বেশি মজা লাগে।’
ইয়াসমিন বেগম বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, সঙ্গে জলপাইয়ের আচার, গরুর মাংসের চপ, কষানো মুরগির মাংস, সালাদ, কোল্ড ড্রিংকস, দই-মিষ্টি এসবও থাকবে। যান, আপনি গিয়ে আগে ওদের দু’জনকে কথা বলার জন্য রেখে আসেন। খাবার গরম হতে-হতে ওরাও কথা বলা শেষ করে এসে একসঙ্গে খেতে বসতে পারবে।’
তিন
ঘরোয়া ছোট্ট পরিসরে সুমন আর ঈশিতার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ঈশিতার সঙ্গে ওর মা ইয়াসমিন বেগমও সুমনদের বাড়ি চলে এসেছেন। ঈশিতা বিয়ের আগেই সুমনকে বলেছিল, তার মাকেও তার সঙ্গে এনে রাখার কথা। কারণ, ঈশিতা ছাড়া এ জগতে ইয়াসমিন বেগমের আর কেউ নেই। এই বয়সের একজন মহিলা কী করে একা-একা থাকবেন?