‘তারপর, রিয়া? কী ঘটল?’ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জানতে চাইলাম। আমাকে যেন টানছে রিয়ার কথা। আমি অসহায়! ওর পুরো গল্প না শুনে নিস্তার নেই!
‘স্বপ্নে শুধু রক্ত, রক্ত আর রক্ত। তাজা চটচটে রক্তের ভেতর হামাগুড়ি দিই আমি। আশ্চর্য! এবারে আমার ভূমিকা টোকাইয়ের। আমার কাঁধে প্লাস্টিকের থলে। পানি ও কোমলপানীয়ের বোতল খুঁজে খুঁজে থলে ভরি আমি। সহসাই এক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন সুয়েরেজ লাইনের ধারে দেখলাম চটের একটা থলে। নিশ্চয়ই ভেতরে দামি কিছু আছে। ত্রস্ত হাতে থলের মুখ খুলে দেখি…’ থেমে গেল মেয়েটা।
‘কী দেখলে, রিয়া!’ আমার যেন তর সইল না। স্পেলবাউণ্ড। নির্নিমেষ চেয়ে আছি রিয়ার দিকে
‘বিশ্বাস করুন, করুন, স্যর, থলের ভিতর শুধুই রক্ত। রক্তভেজা লাশ।’
‘কার লাশ! চিনতে পারলে?’
‘পেরেছি, স্যর। পেরেছি। আমার সবচে’ প্রিয় একজন মানুষ! একটু আগেও যে আমার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিল!’ আবার কাঁদতে লাগল রিয়া।
‘কে, তোমার রুমমেট এশা?’
‘ঠিকই ধরেছেন। বস্তার ভেতর রক্তস্নাত একটি মেয়ের লাশ। অনেক চুল। তাকিয়ে দেখি এশা। কেউ ঘাড় মটকে রক্ত খেয়েছে ওর। ঘোলা চোখে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে এশা। কী করুণ সে চাহনি! কী নিদারুণ!’
শ্বাস বন্ধ করে শুনছি। বুকের ভেতর হচ্ছে ঢিব-ঢিব শব্দ। কেবলই মনে হচ্ছে, কী শুনব এবার! এশা মেয়েটা সত্যি মরে গেল! নাকি মরেনি! হে, স্রষ্টা, রিয়ার এই স্বপ্নটা যেন অন্তত মিথ্যে হয়! এশার মত ভাল মেয়ের অনেক, অনেক দিন বেঁচে থাকা দরকার। দুনিয়াটা দিনকে দিন চিড়িয়াখানা বা ল্যাবরেটরি হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে এতটুকু মায়া-মমতা নেই! মানুষ কেটে এক শ’ উনিশ টুকরো করা হয়!
আমি রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। অথচ আমাকে শোকের সাগরে ভাসাল ও। জান্তব গোঙানির মত করে বলল, ‘এশা বাঁচেনি। অনেক মেয়ের হাঁকডাকের শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। ঘুম নয়, এ যেন মরণঘুম। ওরা আমাকে ডেকে তুলে এশার কথা জানতে চাইল। এশা কোথায়! লেডিস হলের পেছনে ড্রেনে পাওয়া গেছে একটা মেয়ের লাশ। দেখতে এশার মত। কিন্তু এশা সেখানে যাবে কেন! এই কেন’র জবাব কেউ জানে না, শুধু আমি জানি, স্যর। হলের সব রুম, ওয়াশরুমে খুঁজেও পাওয়া গেল না এশাকে। ওর চেহারাটা এমন বীভৎসভাবে থেঁতলে গেছে, চেনার উপায় নেই। অনুমান করা যায়, কোনও এক রহস্যময় কারণে ভোর রাতে পাশের ভবনের ছাদে গিয়েছিল এশা। সেখান থেকে পা ফসকে পড়ে ঘাড় মটকে মরে গেছে ও। উপুড় হয়ে পড়েছিল, তাই থেঁতলে গেছে পুরো মুখমণ্ডল। উহ্, কী ভয়ঙ্কর সেই চেহারা! স্যর, আমি অপয়া! আমি অভিশপ্ত! এখন কী করব বলুন, বলে দিন প্লিজ!’
কান্নায় ভেঙে পড়ল রিয়া। এই কান্নার যেন কোনও শেষ নেই।
শীতের অনুভূতিটা আরও বেড়েছে আমার। ডিনারের কথা ভাবলাম। রিয়াকে কিছু খেতে দেয়া দরকার। বড্ড ক্লান্ত মেয়েটা। এমন কিছু ওকে দিতে হবে, যাতে ঝিমিয়ে না পড়ে।
.
এখন কাকভোর।
নিতান্ত স্বার্থপরের মত ডক্টর ফয়সালকে ফোন করে জাগিয়ে তুললাম।
ফোন পেয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলল সে, ‘কী ব্যাপার, ভাই, কোনও বিপদ! এত রাতে ফোন করেছ?’
‘বিপদ, ভীষণ বিপদ আমার।’
‘তোমার বিপদ! কী হয়েছে, বলো?’
‘আচ্ছা, ফয়সাল, এমন কোনও ওষুধ কি আছে, যা খেয়ে দু’দশ দিন ঘুমটাকে আটকে রাখা যায়?’
‘তুমি কি পাগল হলে? এমন ওষুধ দিয়ে কী হবে! মানুষ ঘুমানোর জন্য ওষুধ খায়, জেগে থাকার জন্য খায় বলে তো শুনিনি!’
‘তার মানে অ্যান্টি-স্লিপ জাতীয় ওষুধ নেই, যাতে আর ঘুম আসবে না?’ হতাশায় ভেঙে পড়লাম আমি। যেমন, করে হোক, রিয়াকে জাগিয়ে রাখতে হবে। কিছুতেই ঘুমোতে দেয়া চলবে না। আমি মরে যাব, ঘুমোলেই ও স্বপ্ন দেখবে, আমি ফিনিশ!
আমার ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে! সেটা গাণিতিক!
রিয়ার বলা তিনটি ঘটনা রিপ্লে করে দেখলাম, সে প্রথম স্বপ্ন দেখেছে ১৩ জুন, ২০১০ সালে। ১৩ জুন (ইংরেজি ক্যালেণ্ডারে সিক্সথ মাস) মানে মাস ও তারিখের সংখ্যাটা যোগ করলে দাঁড়ায় ১৯।
দ্বিতীয় ঘটনার (সুমন-ছোটনের পানিতে ডুবে মৃত্যু) তারিখ ৭ ডিসেম্বর, এক্ষেত্রেও যোগফল ১২+৭ = ১৯।
লাস্ট ঘটনা এশার মৃত্যু দিন ১৫ এপ্রিল। যোগফল
কত! ১৫+৪ = ১৯!
ভাবতেই ভয়ে কণ্ঠনালীতে উঠে এসেছে হৃৎপিণ্ড! আজ কত তারিখ!
১১ আগস্ট!
যোগফল ১৯!
তার মানে আমার মৃত্যু অবধারিত!
ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছি!
রিয়া বোধ হয় বুঝল আমার মনের কথা। কণ্ঠে বৃষ্টির ঘ্রাণ মেখে নিয়ে বলল, ‘ভয় পাবেন না, স্যর। আপনার ক্ষতি হোক, তা চাই না। আমি আপনাকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। আপনি আমার খুব প্রিয় লেখক। জানি, আমি সবার জন্য বিপদের কারণ। বিশেষ করে আমার প্রিয়জনদের জন্য। যাকেই ভালবাসি, আমার দুঃস্বপ্ন তাকে পাঠিয়ে দেয় ওপারে। আমি আজ তাই তৈরি হয়েই এসেছি।’
‘মানে? এসব তুমি কী বলছ, রিয়া?’
‘মানে, আমি আর বেশিক্ষণ নেই। একটু পর চিরবিদায় নেব দুনিয়া থেকে। শুরু হয়ে গেছে ওষুধের প্রতিক্রিয়া 1 মরে যাচ্ছি, স্যর। ভাববেন না, পুলিশ যাতে আপনাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে, তাই সুইসাইড নোট লিখে রেখেছি। ভাল থাকবেন, স্যর, অ…নে…ক…ভা-ল…’
জ্ঞান হারাল রিয়া।
লোকাল থানা ও হাসপাতালে ফোন করলাম। এখনও লোপ পায়নি আমার ইন্দ্রিয়!