‘তারপর? বলো, রিয়া, আমি পুরোটা শুনতে চাই।’
‘আর কী! পরদিন সকালেই কক্সবাজার থেকে ফিরলাম ঢাকায়। বাসায় গিয়ে দেখি সবার মুখ থমথমে। ওরা আমাকে দোষ দিল। তত দিনে সবাই জেনে গেছে আমার স্বপ্নতত্ত্ব। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ওরে, সর্বনাশী, সুমন-ছোটন আর নেই রে! তুই স্বপ্নে কী দেখেছিস বল্! ওরা দু’ভাই মাছ ধরতে গিয়ে ডুবে মরেছে বিলের পানিতে।’’ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকল রিয়া। ওর কষ্টের যেন অবধি নেই। ওর মা-ও দোষারোপ করছেন। রিয়া অপয়া!
‘হুম!’ এবার কী বলা উচিত বুঝলাম না। তা-ও জানতে চাইলাম, ‘তোমার বোনের ছেলেদের বয়স কত? উচ্চতা?’
‘আট আর দশ বছর। উচ্চতা আড়াই ফুটের মত, যেমনটা উত্তাল সাগরের সেই ভেসে যাওয়া সাদা কাফনে দেখেছি আমি।’
রিয়া কাঁদতে থাকল।
টের পেলাম, ওর বুকটা ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে নুড়ি-পাথরের মত। খুব কাছের লোকেরা রিয়াকে ‘অপয়া’ মনে করে ওর স্বপ্নের জন্য। আমার ভেতরে শীতটা আরও জেঁকে বসল। অথচ এখন মিডসামার! গরমে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ!
রিয়া ফোঁৎ-ফোঁৎ করে কাঁদছে। কান্নার বেগ কমলেও আবেগে কমতি নেই।
ওর কষ্ট আমার বুকেও বাজল। বেচারি রিয়া, ওর কী দোষ! আমি কফি বানালাম। দার্শনিকের মত নিরাসক্ত গলায় বললাম, ‘ছি, রিয়া, কাঁদে না। এই নাও কফি। খেয়ে দেখো ঠিক আছে কি না চিনি। আর কিছু? ওহ্! ডিনার খাবে আমার সঙ্গে? যা আছে, বেশ হয়ে যাবে দু’জনের। কোরালের কোপ্তা, বেগুনভাজা আর ঝো-ঝা-চি।’
‘ঝো-ঝা-চি?’ বিস্ময়ভরা চোখে রিয়া তাকাল।
যাক, থেমেছে বেচারির কান্না।
‘ঝো-ঝা-চিটা আমার অবিষ্কার। লণ্ডনে পড়ার সময় এক হাতে সব করতে হত। ওখানে সবচে’ সস্তায় পাওয়া যায় গমের রুটি, মুরগির ডিম আর ফার্ম-কক্। ঝো-ঝা-চি মানে ঝোল-ঝাল চিকেন। একবারে মশলা দিয়ে কষিয়ে বসিয়ে দিই সসপ্যানে। ব্যস, দশ মিনিটে রান্না শেষ। গরম ভাতের সঙ্গে ঝাঁঝাল চিকেন। আর কী চাই!’
‘আপনি রান্নাও জানেন?’ রিয়ার বিস্ময়ের অবধি নেই।
‘কেন, যে চুল বাঁধে, সে কি রাঁধে না! লেখক বলে কিন্তু কুঁড়ে নই। আই’ম আ সেল্ফ-মেড ম্যান, বুঝলে? তুমি বরং এক কাজ করো, মুরগি আর কোরালটা মাইক্রোওভেনে গরম করে আনো। দু’জনে বসে খাই।’
আমার একদম খেয়াল ছিল না, রাত প্রায় একটা। রিয়া ফিরবে কী করে! বয়স যত হোক, বদনামের সময় এখনও পেরোয়নি। লোকে শুনলে বলবে কী! আমি শিহরিত হলাম, শঙ্কিতও। রিয়া অবশ্য আমার কোনও কথাই কানে তুলল না। কফিতে একবার মাত্র চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল তার তৃতীয় ঘটনা।
আরও একবার আতঙ্কিত হবার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করলাম।
‘এই তো সেদিন। তারিখটা ১৫ এপ্রিল, ২০১২। আমার সেকেণ্ড ইয়ার ফাইনাল এক্যাম চলছে। পড়াশুনোর খুব চাপ। রাত জেগে পড়ছি। অনেক দিন দুঃস্বপ্নের ব্যাপারটা ছিল না। ভাবলাম, স্রেফ কাকতালীয়। ওটা কেটে গেছে। কিন্তু জানি, আমি অভিশপ্ত।’ এটুকু বলেই কান্নার পাঁয়তারা শুরু করল রিয়া।
আমি ওর কাঁধে আলতো হাত রাখলাম বড় ভাইয়ের মত। ‘তোমাকে আর ওসব বলতে হবে না। চলো, খেয়ে নিই।’
রিয়া নাক টানল। স্কার্ফে চোখ মুছে নিজেকে সামাল দিল। তারপর আবার শুরু করল বলতে: ‘আমাদের ইউনিভার্সিটির ভেতরটা একটু জঙ্গুলে, আপনি জানেন। বেশ তপোবনের মত মনে হয়! সেবার মাঝরাতেরও পরে শুরু হলো আমার মাথাব্যথা। তারপর বিবমিষা। ব্যথার তীব্রতা এত বেশি, একবার মনে হলো কিছু একটা খেয়ে মরে যাই। আর সহ্য হয় না।’
বাংলা ভাষাকে ভালবাসি, তাই ‘বিবমিষা’ শব্দের মানে জানা ছিল। বমির ভাব। মেয়েটা সত্যি বাংলা জানে। ওর লেখক হওয়া উচিত। ইদানীং অশিক্ষিত লেখকের প্রাদুর্ভাব বেশ দেখছি। বইমেলায় ফি-বছর চার হাজার বই বেরোয়, যার অধিকাংশ পাঠের অযোগ্য। ভাব ও ভাষা দুটোরই আকাল। প্রকাশকেরও যেন দায় নেই। লেখকের টাকায় ভুলে ভরা বইয়ের এক শ’ কপি ছেপেই তিনি প্রকাশক। পত্রিকায় সচিত্র সাক্ষাৎকার ছাপে! লেখকের পকেটের টাকা নেন, প্রকাশকের তাই লেখার গুণগত মান দেখা বা বোঝার সুযোগ থাকে না।
জটিল ভাবনা থেকে রিয়ার কথায় মাটিতে ল্যাণ্ড করলাম। আশ্বাসের সুরে বললাম, ‘ও কথা বলতে নেই, রিয়া। মানব জীবন খুব প্রার্থিত। বড় মূল্যবান। এ নিয়ে ছেলেখেলা করতে নেই।’
বুঝমানের মত মাথা নেড়ে আবার শুরু করল রিয়া: ‘ব্যথা সইতে না পেরে অ্যাসপিরিন খেলাম। আমার রুমমেট এশা দুঃস্বপ্নের কথা জানে না। জানলে হয়তো তক্ষুণি ছুটে বেরিয়ে যেত, বা প্রোভোস্ট ম্যাডামকে বলে আমাকে বের করে দিত রুম থেকে। এশা মেয়েটা বড় ভাল। দিনাজপুর বাড়ি, আমার জন্য প্রয়োজনে জীবন দেবে। এশা এত রাতে হলের ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট নিয়ে এল। ও জানে, কাল আমার পরীক্ষা। বলল, ‘আপু, তুমি বরং এবার একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো। কাল সকালে বাকিটুকু পড়ে একযাম হলে যেয়ো।’ ওর কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মত শুতে যাই। এশা আমার টেবল-ল্যাম্প অফ করে মশারি খাটিয়ে দেয়। আমার দু’চোখে তখন কান্নার ঢল। আমি এশার কথা ভাবছিলাম। এই ‘অপয়া’ মেয়েটার কারণে এশার না জানি কোন্ ক্ষতি হয়! রুমের ভেতর আবছা আঁধারে দেখলাম এশাকে। ওর মুখটা যেন কেউ সুপার গ্লু দিয়ে সেঁটে দিয়েছে আমার চোখে। আমি কেঁপে উঠলাম ভয়ে। অ্যাসপিরিনের প্রভাবে ব্যথাটা কমে গিয়ে কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এই প্রথম বুঝলাম, এবার বিপদ এশার। নিশ্চিত ওকেই স্বপ্নে দেখব। মৌসুমী ভৌমিকের সেই ‘স্বপ্ন দেখব বলে’ গানটা মনে এল। দুটোই স্বপ্ন, অথচ কত তফাৎ! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। শুধু এটুকু মনে আছে, আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এশা, তাতে বড্ড আরাম হচ্ছে আমার। হারিয়ে যাচ্ছি ঘুমের অতলে। বিড়বিড় করে বললাম, এশা মেয়েটা সত্যি ভাল!’